Sunday, October 6, 2024
Homeঅনুশীলনবিশ্ববিদ্যালয় কেমন মানুষ তৈরি করছে?

বিশ্ববিদ্যালয় কেমন মানুষ তৈরি করছে?

Cover jpg copyকিছুদিন আগের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা সবারই জানা আছে। সেসময়ে অনেকগুলো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা দেশে তোলপাড় তুলেছিলো। কেন এমন হচ্ছে- তার কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই। নামকরা বড় বড় বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদগণ দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, উচ্চশিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা যদি এভাবে বিপথে যায় তবে এ দেশের ভবিষ্যৎ কী।’ বহু আলোচনা-সমালোচনা হলো। নিয়ম জারি হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিত থাকা যাবে না। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের একটা তালিকাও তৈরি করা হলো। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলো। এই শেষ নয়। রাস্তাঘাটে তল্লাশি বাড়ানো হলো; ঢাকা শহরের ভাসমান মানুষদের হয়রানি ও উচ্ছেদ করা হলো; মেসে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হলো, মেস ছাড়তে বলা হলো; সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ হলো; জঙ্গি পরিচয়ে মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিরীহ মানুষদের আটক করা হলো। নাজেহালের এক শেষ হলেন সাধারণ মানুষ।

এসব করে মূল সঙ্কট আড়াল করা যায় না। বরং মানুষের মধ্যে ভয় আর আতঙ্ক বাড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের আসা নিশ্চিত করলেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ-জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড যে বন্ধ হয় না, তা সরকার বাহাদুরও জানে। কিন্তু তবুও তারা এভাবে ব্যাপারটিকে উপস্থাপন করে। মানুষকে বিভ্রান্ত করে। কেননা সাধারণ মানুষ বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও অনেকেই ঘটনার কারণ বুঝতে পারে না। অতীতের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের সাথে বর্তমানের অধঃপতিত অবস্থার মিল খুঁজে পায় না। তাই অনেকে বলে, দেশের তরুণ-যুবকরা তো এমন ছিলো না। ’৫২, ’৭১ তো সৃষ্টি করেছে তারাই। এদেশের গর্ব করার মতো সমস্ত ঘটনায় তো ছাত্রদের সংগ্রামী ভূমিকা ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তো বলা হতো জনগণের ‘ক্যান্টনমেন্ট’। ছাত্রসমাজ ছিলো দেশের মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক। সেখানেই তো দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে কত কত আন্দোলন গড়ে উঠেছে। শিক্ষায়-জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রেখেছে। তাহলে আজ কেন তাদের এমন পরিণতি? প্রশ্নগুলো জটিল, উত্তর খুঁজতে হলে তাই সমস্যার গভীরে যেতে হবে।
তরুণদের মধ্যে জ্ঞানচর্চা, মানুষ হওয়া, চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখার কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণা হলো এখানে উন্নত জ্ঞানের চর্চা, জ্ঞানের সংরক্ষণ এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টির নানামাত্রিক আয়োজন থাকে। শিক্ষার্থীরা দেহ-মনে বিকশিত হবার সুযোগ পায়। কিন্তু আজকে তার কতটুকু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পূরণ করতে পারছে? প্রথমবর্ষে একজন শিক্ষার্থী আসে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’ নিয়ে থাকে উচ্চধারণা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নগুলো মলিন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করে দেয় প্রশ্ন করার শক্তি, ক্ষমতাসীনরা স্থাপন করে আনুগত্যের বোধ। সামগ্রিক পরিবেশ তাকে শেখায়- টিকে থাকতে হলে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকতে হবে। এই নষ্ট পরিবেশ ধ্বংস করে মনুষ্যত্ব-মানবিকতা এবং সৃজনী শক্তিকে। এই গভীর সংকট কাটবে কীভাবে?

শুরুতেই একটি কথা বলে নেয়া ভালো যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা একটি দেশের সামগ্রিক শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতির সাথে যুক্ত। বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। যদি প্রাথমিক শিক্ষাতেই গলদ থাকে তবে তা উচ্চশিক্ষাকেও প্রভাবিত করে। তারপরও উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমকে আলাদাভাবে চিত্রিত করার কারণ তাতে মননশীলতা-সৃজনশীলতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে। এই দিক থেকে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা যদি দেখি, বুঝতে পারব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমের প্রত্যেকটা ধাপেই গলদ আছে। এখানে ভর্তিপ্রক্রিয়া এবং যেকোনো বিষয়ে পড়ার পদ্ধতিটাই ত্রুটিপূর্ণ। শুরুতেই একজনকে প্রচন্ড প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। ব্যাপারটা তার কাছে অনেকটা লটারির টিকিটে পুরস্কার পাওয়ার মতো হয়ে দাঁড়ায়। লাগতেও পারে, নাও লাগতে পারে। কোথায় পড়বে আর কোন বিষয়ে পড়বে তা একজন শিক্ষার্থীর কাছে একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। তাই অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পরীক্ষা দিতে হয়। এতে একদিকে যেমন অর্থের জলাঞ্জলি অন্যদিকে এক ধরনের মানসিক অস্থিরতাও তৈরি হয়। বেশিরভাগক্ষেত্রে যে বিষয়ে পড়ার সুযোগ সে পায়, তা তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়না। আবার কোনো একটি বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া এতই দুর্লভ ব্যাপার যে, ছেড়েও যেতে পারে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই ছাত্র-ছাত্রীরা একটা মানসিক দোদুল্যমানতা ও অস্থিরতায় পড়ে যায়। পড়তে আনন্দ লাগে না। অনুভব করে, সবক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভর্তি হতে হয় প্রচ- প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে; ভর্তি হবার পর ক্যারিয়ার-প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতে হয়। এতসব লক্ষ্য পূরণের জন্য জীবনের শখ-স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেক সময় একজন ছাত্রকে যা ছাড়তে হয় তা হয়তো তার শখ-ভালোবাসা, আর যা সে করে তা তার বাধ্যবাধকতা। এমন অবস্থা উচ্চশিক্ষার প্রতি যথার্থ আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না।
কোন বিষয়ে সে পড়বে তা নির্ধারণ করে দেয় পারিপার্শ্বিক সমাজ, পরিবার সর্বোপরি বাজার অর্থনীতি। অর্থাৎ ওই বিষয়ের চাকুরির বাজারে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু- তা-ই হয় পড়বার মাপকাঠি। একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘ভালো’ সাবজেক্ট, ‘খারাপ’ সাবজেক্ট। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত নন। এ প্রসঙ্গে কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জন শিক্ষার্থীর সাথে। আইন বিভাগের প্রথমবর্ষে পড়া একজন শিক্ষার্থী ওরিয়েন্টেশন ক্লাশে এসে শুনলো, ‘তোমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্র। তোমরা আইনের মতো একটা ভালো সাবজেক্টে চান্স পেয়েছো।’ একই শিক্ষাবর্ষের সংস্কৃতে পড়া আরেকজন শিক্ষার্থীকে শুনতে হলো, ‘সংস্কৃতে তো অনেকে পড়তে চায় না। তোমরা কারা কারা এই সাবজেক্টে পড়বে, আরা কারা আবার ভর্তি পরীক্ষা দেবে হাত তোলো।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়া এক শিক্ষার্থী বললো, প্রথমবর্ষে তাদেরই একজন শিক্ষক বলেছে, ‘বাংলায় বেশি পড়তে হয়না। তোমরা একাডেমিক পড়া পড়বে তিন মাস। আর চাকুরির পড়া পড়বে নয় মাস। নাহলে চাকুরির বাজারে ভালো করতে পারবে না।’ শিক্ষকরাই যখন এভাবে বিষয়ের ‘ভালো-মন্দ’ নির্ধারণ করেন তখন শিক্ষার্থীর মধ্যে পঠিত বিষয় সম্পর্কে ‘সুপিরিয়রিটি-ইনফেরিয়রিটি’র বোধ তৈরি হবে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কি এমন হওয়া উচিত? এসব চিন্তা কি শিক্ষার্থী মনঃস্তত্বে প্রভাব ফেলে না? শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র-সংকীর্ণ চিন্তাকে উস্কে দেয় না?

সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত্বের ক্ষেত্রে। শিক্ষা তো সামাজিক প্রয়োজনের জন্য, সামাজিক স্বার্থের জন্য এবং সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে সামাজিক ক্রিয়ার জন্য। তা কোনো মতেই ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। কোনো দক্ষতা যেটা একজন শিক্ষার্থী অর্জন করে তা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে পারেনা। কারণ উৎপাদনের চরিত্রই এখন সামাজিক। এগুলো সবই সামাজিক প্রয়োজনে এসেছে এবং সে প্রয়োজনে কাজে লাগে। কেউ যদি নিছক ব্যক্তিগত অর্থে শিক্ষাকে কাজে লাগাতে চায়; তবে মানবিকতা-মূল্যবোধ, সমাজের প্রতি দায়বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-স্নেহ ইত্যাদির বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। সমাজবিমুখতা যুবক-তরুণদের প্রবল প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেয়। এরকম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে নানা ধরনের হিংসা-বিদ্বেষের চর্চা করতে সে বাধ্য হয়। জীবন ধারণ করার জন্য যত ধরনের ফাঁকি-সুবিধা, অনৈতিক কর্মকান্ড আছে, সে সবের মধ্যে আশ্রয় নেয়। ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য যেকোনো অন্যায় কাজ করতেও দ্বিধা করে না।

সোভিয়েত রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ডিয়ানা লেভিনের ‘চিলড্রেন ইন সোভিয়েত রাশিয়া’ বই থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। এখানে লেখিকা একজন শিক্ষিকা, যিনি সোভিয়েত রাশিয়ার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তাঁর অভিজ্ঞতাতে সোভিয়েতের একটি স্কুলশিশুর বর্ণনা আছে। “…….রেমন্ডকে নিয়ে প্রথমে আমি অসুবিধায় পড়লাম কারণ আপাত দৃষ্টিতে তাকে অলস ও শ্রমবিমুখ বলে মনে হয়। সাধারণত সে প্রশ্ন করলে জবাব দেয়- ‘আমি জানি না’, যেন জানা বা না জানা সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। স্কুলের পর তার সাথে আলাদাভাবে কথা বললাম এবং কয়েকটা বিষয়ে তাকে পরীক্ষা করলাম। অঙ্কে তার পারদর্শিতা দেখে জিজ্ঞাসা করলাম- ক্লাসে অন্যান্য বিষয়েও এমনি মনোযোগ দাও না কেন? ছেলেটি জবাব দিল- তাতে আমার লাভ কি হবে? বড় হলে আমি উড়োজাহাজের নকসা আঁকবো, আমার কেবল মাপতে জানলেই হল এবং তা আমি বেশ ভালোভাবেই জানি।
…..আমি বললাম, রেমন্ড তুমি যদি উড়োজাহাজের ভালো নকসা আঁকতে শিখতে চাও, তাহলে তোমাকে ভালো করে অঙ্কও শিখতে হবে। এমনকি ডেসিমাল ও ফ্র্যাকশনের সাহায্যে কিভাবে গুণতে হয় তাও তোমার জানা উচিত। কোন্ কোন্ জায়গা দিয়ে তোমার উড়োজাহাজ যাবে এবং সেখানকার আবহাওয়া কি তা জানতে হলে তোমাকে ভূগোল আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞান না শিখেও উপায় নেই। তুমি কি মনে করো না যে তোমার একজন পুরোদস্তুর শিক্ষিত লোক হওয়া উচিত?
….ধীরে ধীরে টেকনিক্যাল কেন্দ্রের গ্রুপ লিডারের সহযোগিতায় রেমন্ড ক্লাসে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতে লাগলো। তারপর স্কুলের উড়োজাহাজ মডেল নির্মাণ বিভাগে রেমন্ডকে সম্পাদকের পদ দেয়া হলো।…. সে অন্যান্য ছাত্রদের মতনই যতœ নিয়ে পড়াশুনা করতে লাগলো, সে বুঝতে পেরেছে যে তাকে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে একমাত্র মাপতে জানলেই চলবে না। অন্য শিক্ষণীয় বিষয়েও তাকে জ্ঞানার্জন করতে হবে।”

একজন শিক্ষার্থীর আগ্রহকে বুঝতে পারা, পঠিত বিষয়ের সাথে প্রায়োগিক দিকটিকে নির্দিষ্ট করা এবং সামাজিক প্রয়োজনের বিষয়টি মূর্ত করতে পারলে তার ফলাফল যে কত উন্নত হয়, এ হয়তো তারই একটি উদাহরণ। জ্ঞানের কোনো বিষয়েরই যে ‘ভালো-মন্দ’ হয় না বরং প্রতিটি বিষয়ই যে পরস্পর সম্পর্কিত, তা এই ঘটনাটির মাধ্যমেও বোঝা যায়। একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্কুলস্তরেই এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে পেরেছিলো। যদিও আমাদের দেশের শাসকরা গত ৪৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও এমন জাতের শিক্ষার কথা ভাবতেও পারেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত প্রতিটি বিষয়ের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু সামগ্রিক পরিবেশের মধ্যে যখন একজন শিক্ষার্থী শেখে যে সে পড়াশুনা করছে একটা চাকুরির জন্য, তখন আসলে তার বৃহৎ উদ্দেশ্যটা মার খায়। চাকুরি কিংবা প্রতিষ্ঠার জন্যই পড়াশুনা- এই চিন্তা সমাজে প্রবল বলে একজন ছাত্র নিজের পঠিত বিষয়ের সাথে জীবনের বা সামাজিক প্রয়োজনের কোনো যোগ খুঁজে পায় না। ডিগ্রি লাভকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে দেখে। আর তা হবেই না বা কেন? বিষয়বস্তুর প্রয়োগ তো সে দেখতে পায় না। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় জ্ঞান প্রযোজিত হলেই না সেই জ্ঞান জীবন্ত হয়। সেভাবে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরানন্দ পরিবেশের প্রভাব ক্লাশে শিক্ষার্থী উপস্থিতির ক্ষেত্রেও পড়ে। শিক্ষার্থীরা থাকে ক্লাশবিমুখ। তাই নিয়ম করে ক্লাশ উপস্থিতির জন্য ১০ নম্বর রাখা হয়েছে। নম্বরের এমন বাধ্যবাধকতা শিক্ষার্থীদের ক্লাশমুখী করলেও, পড়াশুনার নিশ্চল অবস্থার কোনো পরিবর্তন আনেনি।

বাজার কেবল শুধু কোন বিষয়ে পড়বে, কোথায় পড়বে এসব ব্যাপারে ঠিক করছে না; যুবক-যুবতীদের চলা, ভাবা, কল্পনা করা, কথা বলা- সবকিছুই কর্পোরেটরা নিয়ন্ত্রণ করছে। কর্পোরেট সমাজের উপযোগী হয়ে ওঠার জন্যই এখন শিক্ষা গ্রহণ করা। গোটা মনন জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। বিরাট টাকার মালিক হওয়ার জন্য, স্টার হওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা ছুটছে। বাজার অর্থনীতি তার নৈতিক মেরুদন্ডটিকে ভেঙ্গে দু’ভাগ করে দিয়েছে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও দর্শন নিয়ে ভাববে এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা এখন খুব অল্প। তাদেরকে শেখানো হচ্ছে, ভেবে কী লাভ? তুমি আগে তোমার ভবিষ্যৎটা দেখো। এভাবে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে নিজের ভবিষ্যতের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তার দেখা পাচ্ছেনা। দেখা না পাওয়া লোকেরা পরস্পরের সাথে মিলতেও পারছেনা। লক্ষ-কোটি ছেলেমেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণ কী তারও উত্তর পাচ্ছেনা। কারণ প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। সবাই নিজেরটা ভাবছে। টিকে থাকার জন্য যেকোনো নোংরা কাজ করতেও অনেকের বাঁধছেনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বলা হয় উচ্চশিক্ষা। গবেষণা ছাড়া উচ্চশিক্ষার কোনো তাৎপর্য আছে কি? ন্যূনতম গবেষণার সুযোগ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় কোনো বিভাগেরই নেই। কলা এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিষয়গুলোতে গবেষণায় বরাদ্দের হার শূন্যের কোঠায়। ফলে পুরনো নোট, বহু বছরের প্রায় অপরিবর্তিত সিলেবাসের মধ্যেই ঘুরপাক খায় তথাকথিত ‘উচ্চশিক্ষা’। এমন বন্ধ্যা অবস্থার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে শেখে না, কেবল উত্তর মুখস্ত করে। নতুন নতুন প্রশ্ন তৈরি না হলে কখনও পুরনো চিন্তার জট ভাঙ্গে না। নতুন সত্যও সৃষ্টি হয় না। মননকাঠামো স্থবির, কূপমন্ডূক থাকলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হয় প্রতিক্রিয়াশীলদের এবং শাসকদের। বদ্ধ জলাশয়ে যেমন শ্যাওলা জমে, তেমনি বদ্ধ চিন্তার মানুষকে খুব সহজেই পুরনো, বস্তাপচা, মধ্যযুগীয় এবং প্রবৃত্তিকে উসকে দেয় এমন চিন্তায় আচ্ছন্ন করা যায়, তার পরিপূরক কর্মকান্ডেও যুক্ত রাখা যায়। এমন মানুষ নিজের অজান্তেই প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।

সমাজে প্রশ্নের শক্তিকে জাগরূক রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার কথা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের। সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষকদের। কিন্তু তা কি তাঁরা রাখতে পারছেন? এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের খুব সামান্যই গবেষণার জন্য একজন শিক্ষক পান। তাই কারও ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অসঙ্গতির কারণে গবেষণাধর্মী কাজ করতে পারেন না। তবে সবচেয়ে সঙ্কট মানসিকতার জায়গায়। নতুন জ্ঞান সৃজন নয়, অর্থকেই পরমার্থ করছেন অনেক শিক্ষক। এক বা একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হয়ে, বিভাগেই বাণিজ্যিক নানা সান্ধ্যকালীন-উইকেন্ড কোর্স খুলে, নামে-বেনামে ফি বাড়িয়ে শিক্ষকরা নিজেরাই শিক্ষাব্যবসার সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানার্জনের মানসিকতা তৈরি করতে পারছেন না, নিজেরাও সেভাবে গড়ে উঠছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ জার্নালগুলোতে মানসম্মত লেখা প্রায় চোখেই পড়ে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো প্রমোশনের কাজে ব্যবহার করা হয়। তাদের কাছে শিক্ষকতা কোনো সৃষ্টিশীল ব্যাপার নয়, অন্যান্য আট দশটা চাকুরির মতো। এভাবে জ্ঞানহীন শিক্ষা এবং তার সাথে যুক্ত সার্টিফিকেট ব্যবসা ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ককে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কে পরিণত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এর চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে?

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিভাগে সেমিস্টারপদ্ধতি চালু আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা বাড়াতে ক্লাশ টেস্ট, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদি ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কতটুকু কার্যকর হচ্ছে এই শিক্ষাপদ্ধতি? সেমিস্টারপদ্ধতি চালু হবার কারণে এক বছরের কোর্সের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সময় কমেছে। অল্প সময়ে বলে প্রত্যেক কোর্সের প্রাথমিক অংশই কেবল একজন শিক্ষার্থী পড়তে পারে। এর ফলে তার মধ্যে বিষয়বস্তুর সামগ্রিক ধারণা গড়ে উঠে না। নতুন সেমিস্টার শুরু হলে আগের সেমিস্টারের পড়া অনেকেই ভুলে যায়। এমন তাড়াহুড়ার কারণে টিউটোরিয়াল, ক্লাশ টেস্ট এমনকি ফাইনাল পরীক্ষাতেও ছোট সিলেবাসের মধ্যেই একজন শিক্ষককে প্রশ্ন করতে হয়। অ্যাসাইনমেন্টের ক্ষেত্রেও একই কথা- বেশিরভাগক্ষেত্রে তা গতানুগতিক কোনো বিষয়ের উপরে হয়, শিক্ষার্থীরা ‘কপি-পেস্ট’ করে দায়িত্ব সারে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা আসেনা, কেবল প্রাথমিক ধারণাই গড়ে উঠে। শিক্ষাব্যবস্থার এই দুর্বলতা ঢাকার জন্য বেশি বেশি মার্কস দেবার প্রবণতা ও বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে বলে ‘সিজিপিএ’ ভালো আসে। অনেক শিক্ষার্থী-শিক্ষক এতেই খুশি থাকে। কী শিখছে, কী জানছে- তা নিয়ে প্রশ্ন করে না। অথচ উচ্চশিক্ষা মানে তো কোনো বিষয়ের উপর বিশেষ জ্ঞান ও বিশেষ দক্ষতা অর্জন। তার সামান্যই অর্জিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনায়। সিলেবাস-কারিকুলামও যেভাবে সাজানো হয়েছে, তাতে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী ছাড়া মানবিক-সৃজনশীল মানুষ হওয়া বেশ কঠিন। জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়কে বাজারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা আছে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণধর্মী শিক্ষাই প্রধানত দেয়া হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দুরাবস্থার কথা একজন শিক্ষার্থী বলবে কোথায়? কোথায় জানাবে তার দাবি-আকাঙ্ক্ষা -স্বপ্নের কথা? ক্লাশরুম থেকে আবাসিক হল কোথাও কি সে তার মনের কথা বলতে পারে? পারে না। কেননা প্রত্যেক জায়গাতেই আছে তার উপর আধিপত্য করার সুযোগ। ক্লাশরুমে শিক্ষকের পড়ানো, তত্ত্বাবধান করার ধরণ নিয়ে বলতে গেলে বিবেচনা করতে হবে, কেননা শিক্ষকের হাতে (ক্লাশ টেস্ট, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, অ্যাটেন্ডেন্স) আছে ৩০ নম্বর ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ নম্বর। ব্যক্তিগত আক্রোশে এ ক্ষমতা ব্যবহারের নজির আছে ভুরিভুরি। ক্যাম্পাস এবং হলে আছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের প্রবল দাপট। অনেক ক্যাম্পাসে কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। কিন্তু সেখানেও যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্রসংগঠন, তল্পিবাহক প্রশাসন ও শিক্ষকনেতাদের জন্য সংগঠনগুলো প্রকৃত ভূমিকা রাখতে পারে না। সরকারি ছাত্রসংগঠনের আধিপত্য এতটাই প্রবল যে অনেক সময় হল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না। সরকারি দলের অনুষ্ঠান বা মিছিলে যেতে ছাত্রদের বাধ্য করা হয়, হলের ভেতর র‍্যাগিং বা নতুন ছাত্রদের শায়েস্তা করে প্রথমেই তাঁদের ক্ষমতার কেন্দ্র সম্পর্কে শিক্ষাদান করা, এটা প্রায় নিয়মিত ঘটনা। একই প্রক্রিয়ায় অস্ত্র, মাদক, ছিনতাই, নির্যাতন, হয়রানি সবই ক্যাম্পাসে চলে। এমন অগণতান্ত্রিক পরিবেশ শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক মনন কাঠামো তৈরি করবে কী করে? এমন পরিবেশ তো প্রতিক্রিয়াশীলতারই জন্ম দেবে।

ক্যাম্পাসগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসতে পারতো যদি ছাত্ররা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পেতো। এর মাধ্যমে তারা তাদের দাবি-দাওয়াসহ নানা প্রয়োজন নিয়ে কথা বলতে পারতো। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই গত প্রায় দুই যুগ ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নেই। এমন অরাজনৈতিক পরিবেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা পাচ্ছে তথাকথিত ছাত্রনেতা এবং শিক্ষকনেতারা, যারা নানাভাবে দেশের কায়েমী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত।

ফলে ‘নষ্ট’ মানুষ হয়ে উঠার সমস্ত প্রক্রিয়াগুলো ধারাবাহিকভাবে এখানে চালু আছে। জুনিয়র ব্যাচ সিনিয়র ব্যাচের মাধ্যমে যে আক্রমণের শিকার হয়; তা এমন প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তোলে যে, তারা যখন সিনিয়র হয়ে যায় একই প্রক্রিয়ায় পরবর্তী ব্যাচকে আক্রমণ করে। ক্ষমতার এই কাঠামোকে অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে ক্ষমতাসীনরা ছাত্রদের কলুষিত করে। অর্থ আর ক্ষমতার লোভে আক্রান্ত হয়ে, কিংবা ফাঁদে পড়ে কিছু তরুণ হয়ে দাঁড়ায় অসংখ্য তরুণের জন্য বিভীষিকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং কায়েমী স্বার্থের সাথে যুক্ত শিক্ষকরাও তাঁদের ব্যবহার করে। এদের সবার কাছে ছাত্রসংসদ নির্বাচন তাই অপ্রয়োজনীয়। ছাত্ররা যদি তাদের পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করে তাহলে যে ক্ষমতার কাঠামোটি এমন থাকবে না, তা তারা ভালো করেই জানে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। যোগ্যতা না থাকলেও, পদ শূন্য না হলেও দলীয় বিবেচনা, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে হর-হামেশাই শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। শিক্ষক রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার যে কাঠামোটি গড়ে উঠেছে, তাকে টিকিয়ে রাখতেই এমন দুঃখজনক ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে। (তথ্যসূত্র : ডেইলি স্টার, ৩ জানুয়ারি ’১৭)
প্রচন্ড প্রতিযোগিতার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, শিক্ষাজীবনের পুরোটা সময় জুড়ে চাপ, শিক্ষা শেষে অনিশ্চয়তা, চারদিক থেকে প্রত্যাশা পূরণের তাগিদ- সবকিছুর মধ্যে পিষ্ট তরুণ-তরুণীরা। এর সাথে আছে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভর্তি-বাণিজ্য, কোটা বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্যের বিশাল বিশাল পাহাড়। এ পাহাড় ডিঙ্গাতে পারে কয়জন? তখন শরণাপন্ন হতে হয় ক্ষমতাবানদের। একদিকে এত বাধা, অন্যদিকে ক্ষমতার দাপটে সবকিছু হাতের মুঠোয়; একদিকে হাহাকার, অন্যদিকে বাজারের চাকচিক্য; একদিকে বঞ্চনা, অন্যদিকে চোরাই টাকার উৎসব; একদিকে ভোগের টান, অন্যদিকে অক্ষমতার বঞ্চনা। এরকম অবস্থায় ইহকালের অসন্তোষ দূর করতে টানে পরকালের অনন্ত সুখের ডাক। অথবা ক্ষমতার মসনদে আসীন হবার স্বপ্নে ভোগের নীল সাগরের আহ্বান।
এই যখন অবস্থা, তখন কীভাবে একজন শিক্ষার্থী নিজের অন্তর্গত শক্তিকে উপলব্ধি করবে? কীভাবে তার প্রকাশ ঘটাবে? কীভাবে বুঝবে যে, ব্যক্তিগতভাবে আমরা কেউই ততটা শক্তিশালী নই, সমষ্টিগতভাবে যতটা? কীভাবে বুঝবে সমাজের অপরাপর মানুষ তার অস্তিত্বের অংশ? কেবল নিজেরটা বুঝলে বেঁচে থাকা যায় না। যে জ্ঞান আমরা গ্রহণ করছি তা তো সামাজিক সংগ্রামের ফসল। একে নিছক ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা যায় না। এটাও তো উপলব্ধি করতে হবে, শিক্ষার্জন নিছক ডিগ্রি অর্জন নয়; সমাজ ও চারপাশের পরিবেশকে প্রশ্ন করা; বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন করাই প্রকৃত শিক্ষা। এ না হলে এমন দম বন্ধ করা পরিবেশে মুক্তভাবে কি বেঁচে থাকা যাবে? আত্মস্বার্থপরতা আর বিশ্লেষণের ক্ষমতাহীন অবস্থা আমাদের কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে? এর ফলাফলেই তো কেউ সন্ত্রাসী হচ্ছে, কেউবা জঙ্গি হচ্ছে আর কেউ হচ্ছে দেশবিক্রিকারী কর্মকর্তা।

জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে, শিক্ষার্থীদের ক্লাশরুমে ঢুকিয়ে আর হাস্যকর কিছু নিয়ম আরোপ করলে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমন করা যায় না। নির্মূল করতে হয় গোড়ার সঙ্কটকে। যে শিক্ষা প্রশ্ন করতে শেখায় না, অন্ধবিশ্বাসকে ভাঙ্গে না, ক্ষমতার নির্মমতার প্রতি ঘৃণা তৈরি করে না; সেই শিক্ষা মানুষ তৈরির হাতিয়ার হতে পারে না। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। একমাত্র সমাজে চিন্তা-বিশ্লেষণহীন রোবট সংস্কৃতির চাষ বন্ধ হলেই প্রতিক্রিয়ার শক্তি পরাজিত হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই যদি গলদ থাকে তাহলে তার অন্তর্গত বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে প্রগতিশীলতার উদ্বোধন আশা করা যায়? যায় না। রাষ্ট্র নিজেই যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহায় সম্বল অল্প কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হবার বৈধতা দেয়; সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদী চিন্তাকে উস্কে দিয়ে মানুষে মানুষে বিভক্তি আনে; জোর-জুলুম চালিয়ে মানুষের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে; জাতীয় সম্পদ লুটপাট আর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়না তখন তার শিক্ষাব্যবস্থা এমন আত্মমুখী-পরাক্সমুখ শিক্ষাই দিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। অন্যায়কে প্রশ্ন করুক এমন শিক্ষা নিশ্চয় অন্যায়কারী দিতে চাইবে না।

প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে মোকাবেলা করার সবচেয়ে বড় উপায় সমষ্টির শক্তিকে ধারণ করা। জ্ঞান যে আলোর প্রদীপ জ্বালে তাকে ধারণ করে সকল অন্যায়-বৈষম্য-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো; দুর্নীতি-লুটপাট-নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করা, দেশের সম্পদ রক্ষার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হওয়া। একইসাথে যে শিক্ষাব্যবস্থা মানুষ হবার পথকে রুদ্ধ করছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সমাজবোধ, সামাজিক কর্তব্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হলে এমনই একটি নিবিড় সংগ্রাম আমাদের পরিচালনা করতে হবে। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার চেতনাই সূচনা করতে পারে ভবিষ্যতের মানবিক মানুষ নির্মাণের পথ।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র — অনুশীলন ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সূচিপত্র :
পাঠ্যপুস্তকে ভুল, বিষয়বস্তুর পরিবর্তন নিছক দুর্ঘটনা নয়
সরকারি অপপ্রচারের পরও মানুষ সুন্দরবনের পক্ষে
বিশ্ববিদ্যালয় কেমন মানুষ তৈরি করছে
মহান স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে 
‘ভালোবাসা দিবস’র আড়ালে যে রক্তস্নাত লড়াইয়ের ইতিহাস আমরা ভুলতে বসেছি 
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কি এভাবেই চলবে? 
ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও কিউবা 
সংগঠন সংবাদ

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments