Thursday, April 25, 2024
HomeUncategorizedঅসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি, বিপর্যস্ত জনজীবন

অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি, বিপর্যস্ত জনজীবন

মেহের নিগার, ৭০ বছরের বৃদ্ধা। কাঠফাঁটা রোদে সকাল থেকে ৪ ঘন্টা ধরে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঢাকার পল্লবীতে টিসিবির ওএমএস ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন পাঁচ কেজি মোটা চাল কিনবেন বলে।  ছেলে একটি স্কুলের দারোয়ান। ছেলের বউ অনেকদিন ধরে অসুস্থ। নাতি দুটো ছোট। তাই বৃদ্ধ বয়সেও সংসার খরচ বাঁচাতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, “এখন যে অবস্থা, সংসার আর চলে না। সকালে সবাই পানিভাত লবণ দিয়া কছলাইয়্যা খাইছি। রাতে ২০ টাকার ইচা মাছ কিনে ভাউত্যা শাক দিয়ে রান্না হয়। অনেক দিন ধরেই হাক—পাতা খেয়ে আছি। পাঁচ কেজি চাল বাজারে কিনতে ৩০০ টাকার মতো লাগে। ট্রাক থেকে কিনলে ১৫০ টাকার মতো বেঁচে যায়। গরিবের জন্য এটা কম কিসে। গায়ে জোর থাকলে আমিও কাজ করতাম। সেই জোর তো আর নাই।’’

মগবাজারের গাবতলায় সড়কের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান চালান নান্নু মিয়া। দিনে তার আয় পাঁচ—ছয়শ টাকা। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। থাকেন মগবাজার পেয়ারাবাগে, একটি টিনের ঘরে। ভাড়া ছয় হাজার টাকা। বড় অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে আয় ও সংসার খরচ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই একটু বিরক্তবোধ করলেন। প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, “এই ছোট্ট চা দোকান দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালিয়ে আসছিলাম। কয়েক মাসে চাল, তেল, পেঁয়াজ, তরকারির দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে সংসার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে ডাল—আলুই চলছে বাসায়। কখনও ডিমভাজি থাকে। ‘মাছ—মাংস’ প্রসঙ্গ তুললে বলেন, “এগুলো আমার কাছে সোনার হরিণের মতো।”

সমকাল পত্রিকায় গত ১৭ মার্চ প্রকাশিত ‘জীবন সংসার এখন গলার কাঁটা’শিরোনামের রিপোর্টে এভাবেই মূল্যবৃদ্ধিতে অসহায় মানুষের কান্না উঠে এসেছে। করোনা মহামারীর কারণে আয় ও সঞ্চয় কমে যাওয়াসহ যে আর্থিক ধাক্কা, তা এখনও বেশিরভাগ মানুষ পুরো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এর মধ্যে সমস্ত কিছুর মূল্যবৃদ্ধি এ মানুষদের জীবন দুঃসহ করে তুলেছে। টিসিবি ট্রাকের সামনে নিম্নবিত্ত ও সম্প্রতি মধ্যবিত্তদের বাড়তে থাকা ভীড়, পণ্য পেতে মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষা ও মরিয়া চেষ্টা, না পেয়ে কান্না—পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেই নির্দেশ করে।

২০১৯ সালের জানুয়ারি ও ২০২২ সালের এপ্রিলের বাজারদর পাশাপাশি রাখলে বোঝা যাবে, সংসারখরচ কি ভয়াবহ পরিমাণে বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে মোটা চালের কেজি ৩০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৮—৫০ টাকা, ৫৫ টাকা কেজি মোটা মসুর ডাল ১০০ টাকা, সয়াবিন তেলের লিটার ১০৪ টাকা থেকে বেড়ে ১৬৮ টাকা, চিনির কেজি ৫১ টাকা থেকে ৮০—৮৫ টাকা, আটার কেজি ২৮ টাকা থেকে ৪৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সিপিজের জরিপে উঠে এসেছে, মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবারগুলো খাবারের ব্যয় কাঁটছাঁট করেছে ৪৩%। কিন্তু সরকারের কর্তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হবে, সব সরকারে নিয়ন্ত্রণে। পত্রিকায় এসেছে, ”বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অবশ্য জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে তেল, চিনি ও ডালের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছুই করার নেই। ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা তো আর বেশি টাকা দিয়ে পণ্য কিনে কম টাকায় বিক্রি করবে না। এখন আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার অপেক্ষা করতে হবে।”(সাম্প্রতিক দেশকাল ৫ মার্চ, ২০২২)

এবারের দাম বৃদ্ধির কারণ কি? ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশে দাম বাড়ছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, যেসব খাদ্যপণ্য যুদ্ধের আগে আমদানি হয়েছে বা দেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলোর দাম বাড়বে কেন? খাদ্যমন্ত্রীই বলতে বাধ্য হয়েছেন,“বোরোতে বাম্পার ফলন হয়েছে, আমনেও হয়েছে, তারপরও চালের দাম বাড়ছে যা হাস্যকর।”(চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখছি : খাদ্যমন্ত্রী, বার্তা২৪ ডটকম, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) জনগণ পরিষ্কার বোঝে ও জানে, এ মূল্যবৃদ্ধি একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং এ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ।

‘ডয়চে ভেলে বাংলা’-র রিপোর্ট বলছে, “বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমাদানি করা হয় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে। এখন বাজারে যে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে তা আমদানি করা হয় গত ডিসেম্বরে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টনের দাম ছিল হাজার ৪১১ ডলার। অন্যান্য খরচ ধরে সেই তেল প্রতি লিটার এখন ১৫২ টাকায় বিক্রি সম্ভব বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। সে হিসেবে তেলের মজুত ও সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। তারপরও বাজারে এখন সয়াবিন তেল স্বাভাবিক মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা আমদানিকারক, তারা তাদের নির্দিষ্ট ডিলারদের দিয়ে সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুত করে এই সংকট তৈরি করছেন।” (তেল নিয়ে তেলেসমাতি ১১.৩.২০২২ ডয়চে ভেলে বাংলা ) গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণত কুষ্টিয়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ১২—১৫ জন বড় চালকল মালিক। একই এলাকার ৮—১০ টি পরিশোধন কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে চিনির বাজার। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড এ পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে ভোজ্য তেলের বাজার। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ সরকার  এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করবে কি?

মজুতদারি বন্ধ করতে স্থগিত ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন’পুনরুজ্জীবিত করতে হবে

মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেশে কিছু আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। প্রতিযোগিতা আইনে বলা আছে, পণ্য বা সেবার ক্রয়বিক্রয়, মূল্য অস্বাভাবিকভাবে নির্ধারণ করলে, উৎপাদন—সরবরাহ—বাজার সীমিত করলে তা প্রতিযোগিতার পরিপন্থী বলে গণ্য হবে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালে প্রতিযোগিতা কমিশনও গঠিত হয়েছে। কিন্তু লোকবল নিয়োগ না দেয়ায়, সে কমিশন কার্যত ঢাল—তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারের দশায় আছে। একসময় সরকারিভাবে ডাইরেক্টরেটের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী মজুদের সময়সীমা দেখার নিয়ম ছিল। কিন্তু বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ১৯৯৯ সালে সেই সংস্থাটি বিলুপ্ত করা হয়। এখন আমদানিকারক বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য গুদামে দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করতে পারে। মাঝে মাঝে লোকদেখানো ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার নাটক ছাড়া অবৈধ মজুতদারি নিয়ন্ত্রণের কোন পদক্ষেপ নেই। মজুতদারি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১৯৫৬ সালে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। এ আইন অনুসারে পাইকারী ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ৩০ দিন ও খুচরা পর্যায়ে ১৫ দিনের বেশি ধান—চাল মজুদ রাখতে পারে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন ও তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির বড়ি গিলে এরশাদ সরকার ১৯৮৯ সালে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ও ব্যবসায়ীদের মজুদ রাখা সংক্রান্ত এসআরও বাতিল করে। পরর্তীতে বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে খাদ্যশস্যের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর থেকেই খাদ্যশস্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ওপর সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। স্থগিত করা হয় ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন’। ২০১১ সালে ও ২০১৬ সালে দুই দফায় স্থগিত ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ সংশোধন করে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলা হলেও, ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর আপত্তির মুখে আওয়ামী লীগ সরকার তা থেকে সরে আসে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একটা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “একটা কথা হয় সিন্ডিকেট। আমি ১০ বছর মন্ত্রী ছিলাম। আসলে সিন্ডিকেট বলে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। এটা একটা তথ্য সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ীরা আমাদের বন্ধু। আজকের মিটিংয়েও আমি বলেছি, ধরপাকড়, জবরদস্তি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সবাইকে আপন করে নিয়ে সুখ—দুঃখের ভাগীদার হয়ে সমস্যার সমাধান করব।”(বার্তা’২৪,১ ডিসেম্বর,২০১৯) সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যেই স্পষ্ট, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিলেও, কেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। তারা ‘সরকারের বন্ধু’। টিআইবির রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে সংসদের ৬১ শতাংশই ব্যবসায়ী। অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনসমর্থনহীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবসায়ীদের তুষ্ট রাখতে চায়। ব্যবসায়ীরা জানে সরকার কোন কড়া পদক্ষেপ নেবে না, বাজার নিয়ন্ত্রণের সমস্ত হাঁকডাক আমজনতাকে শান্ত রাখার জন্য।

টিসিবি ফ্যামিলি কার্ড

সরকার গরীব— নিম্নবিত্তদের জন্য টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করছে। ঢাকা ব্যতীত সারাদেশে এ ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে, যা দিয়ে তারা শুধু রোজার মাসে দুইবার পণ্য কিনতে পারবেন। এই পণ্যগুলো প্যাকেজে কিনতে হবে। অর্থাৎ কেউ প্রয়োজনে আলাদাভাবে তেল, ডাল ইত্যাদি কিনতে পারবেন না, কিনলে পুরো প্যাকেজই কিনতে হবে। ইতোমধ্যেই এ ফ্যামিলি কার্ড বিতরণে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে দেশজুড়ে। ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, ছোলা, চিনি ইত্যাদি কম মূল্যে দেওয়া হলেও, বাজারে এসব পণ্যের দাম কমেনি। কমার কথাও নয়। কারণ যে ব্যবসায়ীগোষ্ঠী ও ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী যে বড় গ্রুপগুলো (বসুন্ধরা, সিটি গ্রুপ, মেঘনা, সেনা কল্যাণ সংস্থা ইত্যাদি) বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের কাছ থেকেই টিসিবি ফ্যামিলি কার্ডের পণ্য কিনেছে। সরকার যদি টিসিবিকে দিয়ে একই পণ্য সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি করতো, তাহলে তা দেশের বাজারে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রভাব কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারতো। কেন সরকার এ উদ্যোগ নিল না? উত্তর সহজ। সরকার ব্যবসায়ীগোষ্ঠীকেও খুশি রাখতে চায়, আর মানুষকেও দেখাতে চায়, সরকার কত জনবান্ধব। টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ) মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবি করলেও, টিসিবির সে সক্ষমতাই তৈরি করা হয়নি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, “টিসিবি অর্থনীতির মেরুদণ্ড। টিসিবিকে আরও কার্যকর করে গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে টিসিবিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এ সংস্থাকে সক্রিয় করার ফলে যারা সিন্ডিকেট করে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে না। টিসিবিকে কার্যকর করে সাধারণ ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারলে দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না।”

মাত্র ২৭৫ জন জনবল, ঢাকা—চট্টগ্রাম—খুলনা—রাজশাহী এ চারটি আঞ্চলিক কার্যালয়, মাত্র ৬ হাজার ৮৪০ টন ধারণক্ষমতার পণ্যগুদাম ও সারা দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৪০০ ট্রাকে অল্প কিছু পণ্য বিক্রি করে কিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? বাংলাদেশে ইউনিয়ন আছে সাড়ে চার হাজার। তার বাইরে আছে অনেকগুলো পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন। প্রতি ইউনিয়নে ন্যূনতম একটি এবং জনসংখ্যা অনুযায়ী পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে ট্রাক রাখতে চাইলে ট্রাকের প্রয়োজন হতো অন্তত ৬ হাজার। ভোগ্যপণ্যের বড় অংশ আমদানিনির্ভর, যা ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করে। টিসিবি দেশের মোট আমদানির মাত্র ০.৩০ ভাগ আমদানি করে। এ যেন সাগরে একবিন্দু জলের মতো। টিসিবি যে আমদানি করবে, সে অর্থ বরাদ্দই সরকার করছে না। টিসিবির অনুমোদিত মূলধন ৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করে সংসদে বিল পাশ হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু এখনও সে অর্থ বরাদ্দ হয়নি। ফলে টিসিবির ট্রাকসেল বা বর্তমান ধরণের ফ্যামিলি কার্ড বর্তমান সংকট কাটাতে সমাধান নয়।

সর্বজনীন রেশনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন আজ সময়ের দাবি

তাই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীগোষ্ঠী ও অসাধু সিন্ডিকেটের হাত থেকে সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে কিছুটা বাঁচাতে হলে আজ প্রয়োজন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিশেষত চাল, ডাল, আটা, খাবার তেল, চিনি, পেঁয়াজের মতো খাদ্যদ্রব্যের গণবন্টনব্যবস্থা বা রেশনব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন। নব্বই দশক পর্যন্ত আমাদের দেশে রেশনিং ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষ ঠেকাতেই ১৯৪৩ সাল থেকে ভারতবর্ষে রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তা পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশেও চালু ছিল। ১৯৭২ সালে দেশের চারটি প্রধান শহরে অগ্রাধিকার গ্রুপে বিধিবদ্ধ রেশনিং (Statutory Retioning-SR) ব্যবস্থা চালু ছিল। এ চারটি শহর হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনা। ১৯৭৩ সালে রাজশাহীকে এবং ১৯৭৬ সালে রাঙ্গামাটিকে ‘এস আর’-এর আওতায় আনা হয়। এই ছয়টি শহরের সকল বাসিন্দা এবং অগ্রাধিকার গ্রুপ প্রতি সপ্তাহে একবার করে মাসে চারবার রেশন পেতেন। নির্দিষ্ট তারিখে নির্ধারিত রেশন ডিলারের কাছ থেকে তারা রেশন তুলতেন। কম দামে কার্ডধারীরা চাল, ডাল, তেল, লবণ, গম, চিনি, ঘি ইত্যাদি পেতেন। প্রত্যেক ব্যক্তি একটি রেশন কার্ড পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। এর বাইরে কতিপয় অগ্রাধিকার গ্রুপকে সরকারি বিতরণ ব্যবস্থায় রেশন সরবরাহ বাধ্যতামূলক হয়। এদের মধ্যে আছে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, রাষ্ট্র পরিচালিত হাসপাতাল, কারাগার এবং ছাত্রাবাস। বিধিবদ্ধ রেশনিং (এস আর) এলাকাভুক্ত ছয়টি শহরের বাইরে অন্যান্য শহর ও গ্রামাঞ্চলে চালু ছিল সংশোধিত রেশনিং (Modified Retioning-MR) ব্যবস্থা। এতে সব পর্যায়ের সরকারি কর্মচারী, স্কুল শিক্ষক ও সরকারি খাতের শ্রমিকদের রেশনের পুরো কোটা সরবরাহ করা হয়। নব্বই দশক হতে সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিতে থাকে। বাজার মুক্ত করতে হবে, বাজারে রাষ্ট্রের কোন নিয়ন্ত্রণ চলবে না, কোন জিনিস কী দামে বিক্রি হবে বাজারই তা ঠিক করবে, আমদানি—রপ্তানী নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, রেশনে দুর্নীতি হয় ফলে রেশনব্যবস্থা তুলে দিতে হবে–এই ছিলো তাদেও প্রেসক্রিপশন। এই প্রেসক্রিপশনে তৎকালীন বিএনপি সরকার ১৯৯২ সালে খাদ্যে রেশনিং ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলো। মূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিলুপ্ত ও টিসিবির কার্যক্রম একেবারে গুটিয়ে নেয়া হয়। পরবর্তী সরকারগুলো এ দাওয়াই বাস্তবায়ন বহাল রাখে। খাদ্যপণ্য আমদানির উপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়। এর ফল হলো, বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ উঠে গিয়ে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলো। এখন তাদের ইশারাতেই বাজার উঠবস করে। সাধারণ মানুষের রেশন তুলে দেওয়া হলেও আর্মি, পুলিশ, বিজিবি, আনসার, কারারক্ষী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মচারীরা রেশন সুবিধা পেয়ে থাকে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা রেশন সুবিধা ভোগ করেন। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে পুলিশ সদস্যরা রেশন হিসেবে চাল, ডাল, তেল, আটা ও চিনি পেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে পুলিশের সব সদস্য প্রতি কেজি চাল ২ টাকা ১০ পয়সা এবং প্রতি কেজি গম ১ টাকা ৭৭ পয়সা দরে রেশন হিসেবে পান। আনসার, কারারক্ষী, ফায়ার সার্ভিস ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারীরাও একই দরে চাল ও গম উত্তোলন করেন। বিজিবি সদস্যরা প্রতি কেজি ২ টাকা ৫৫ পয়সা দরে চাল ও ২ টাকা ১৫ পয়সা দরে গম উত্তোলন করেন। স্বামী—স্ত্রী, এক সন্তানসহ কারও পরিবারের তিন সদস্য হলে মাসে ৩০ কেজি চাল, ২৫ কেজি আটা, ৭ কেজি ডাল, ৬ লিটার তেল ও ৪ কেজি চিনি পেয়ে থাকেন। কারও পরিবারের সদস্য স্বামী—স্ত্রীসহ চারজন হলে প্রতি মাসে ৩৫ কেজি চাল, ৩০ কেজি আটা, ৮ কেজি ডাল, ৮ লিটার তেল ও ৫ কেজি চিনি পেয়ে থাকেন।

আমাদের দেশে তুলে দেওয়া হলেও, ভারতে গণরেশন ব্যবস্থা সফলতার সাথে চালু আছে। ভারতীয় জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (২০১৩) বা এনএসএফ এর মাধ্যমে গ্রামের ৭৫ শতাংশ এবং শহরের ৫০ শতাংশ নাগরিকের জন্য এটাকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক মৌলিক অধিকারে পরিণত করা হয়েছে। এনএসএফ কার্ডধারীর সংখ্যা প্রায় ২৩ কোটি ৭৫ লাখ, যার আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি ভারতে রেশনের দোকান বা ফেয়ার প্রাইস শপের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ এই রেশনের কার্ড দেখিয়ে রেশনের দোকান থেকে অতিদ্ররিদ্ররা প্রতি মাসে ৩৫ কেজি এবং অগ্রাধিকারভুক্তরা পরিবারের সদস্যপিছু ৫ কেজি করে চাল—আটা যথাক্রমে ২ ও ৩ টাকা কেজি দরে ক্রয় করতে পারে। শুধু তাই নয়, এইসব রেশনের দোকানে রেশন কার্ড ধারীদের কাছে বাজার মূল্যের অর্ধেক দরে তেল, চিনি, ময়দাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও বিক্রি করা হয়। (বাংলাদেশে টিসিবি ট্রাক বনাম ভারতীয় রেশনব্যবস্থা—কল্লোল মোস্তফা, ২ এপ্রিল, ২০২২, দৈনিক সমকাল)। ভারতে রেশনব্যবস্থা ডিজিলাইজেশন করার ফলে রেশনকার্ড নিয়ে দুর্নীতির সুযোগও কমে এসেছে। ভারত যদি রেশনব্যবস্থা চালু রাখতে পারে, বাংলাদেশ কেন রেশনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে পারবেনা?

খাদ্যপণ্যে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু কর

দেশের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যে জিনিসপত্র উৎপাদন হয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মালিকের সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। সমাজতান্ত্রিক দেশে যেমন জনগণের প্রয়োজন মেটানোর জন্য উৎপাদন পরিচালিত হয়, পুঁজিবাদী দেশে তেমন হয়না। জনগণের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়, সর্বোচ্চ মুনাফার জন্যই এখানে উৎপাদন নীতি ও উৎপাদন পরিচালিত হয়। ফলে মূল্যবৃদ্ধি পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী ফল। মালিকের শোষণের ফলে শ্রমিকসহ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে। আয়ের সাথে ব্যয়ের তাল মেলাতে না পারায়, জনগণের নাভিশ্বাস উঠে। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকলে, মূল্যবৃদ্ধির সংকট হতে সাধারণ মানুষের নিস্তার নেই। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও সরকার মূল্যবৃদ্ধি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এ দায়িত্ব সরকার অস্বীকার করতে পারেনা। খাদ্যদ্রব্য যাতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে,তা দেখার দায়িত্ব সরকারের। ব্যবসায়ীরা যাতে মজুতই করতে না পারে, তার বাস্তব অবস্থা তৈরি করা। তা করতে হলে চাই, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে অন্তত খাদ্যের ক্ষেত্রে পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবসা চালু করা। আমাদের দেশে খাদ্যপণ্য উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ ও বন্টনের পুরো ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ীরা। কৃষক অল্প দামে পাইকার, আড়তদার, হিমাগার মালিক, চালকল মালিক, ফড়িয়া এ ধরণের মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় না এবং অতিরিক্ত দামে জনগণকে তা কিনতে হয়। যেসব খাদ্যপণ্য আমদানিনির্ভর, তার দামও নির্ভর করে আমদানিকারকদের উপর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির আঘাত পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়, কিন্তু খাদ্যপণ্য রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সেক্ষেত্রে সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ হতে ন্যায্যমূল্যে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র, এজেন্সির মাধ্যমে খাদ্যশস্য কিনে নিবে এবং যেক্ষেত্রে প্রয়োজন বিদেশ থেকে আমদানি করবে এবং সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলে সে খাদ্যশস্য বিভিন্ন সরকারি বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে  সরাসরি জনগণের কাছে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করবে। এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছোমতো কম দামে কৃষকদের কাছ হতে খাদ্যশস্য কিনতে পারবেনা, ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দিতে পারবেনা। এর ফলে একদিকে কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাবে, অন্যদিকে জনগণ লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি হতে রেহাই পাবে।

প্রশ্ন হলো ‘ব্যবসায়ীদের বন্ধু সরকার’কি তা করবে? ব্যবসায়ীদের সমর্থনে সে টিকে আছে, তারা নাখোশ হবে, এমন পদক্ষেপ কি গ্রহণ করবে? যে সমাজে উৎপাদনের লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন, সেখানে তীব্র গণআন্দোলন না থাকলে মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া হতে বাধ্য। এজন্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার যাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়,সেজন্য চায় ভুক্তভোগী জনগণের সংগঠিত গণআন্দোলন। বাঁচতে হলে সে আন্দোলনে আজ সবাইকে সামিল হতে হবে।

সূত্র:

১.বাংলাদেশে টিসিবি ট্রাক বনাম ভারতীয় রেশনব্যবস্থা—কল্লোল মোস্তফা (২ এপ্রিল, ২০২২, দৈনিক সমকাল)

২.সাপ্তাহিক গণদাবী

সাম্যবাদ এপ্রিল ২০২২ 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments