Wednesday, May 1, 2024
Homeফিচারবাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড-এর বিবৃতি প্রসঙ্গে

বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড-এর বিবৃতি প্রসঙ্গে

12074901_856923947759191_3852988863177628032_n

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (এনটিপিসি) এর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) গত ২০ অক্টোবর এক বিবৃতিতে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যে আন্দোলন তা অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে এর স্বপক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরে। যুক্তিগুলো দুর্বল এবং তা এই পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্পের পক্ষে কোনো নৈতিক অবস্থান দাঁড় করায় না। তারা ওই বিজ্ঞপ্তিতে যে যুক্তিগুলো উত্থাপন করেছেন তা হলো :

# এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণকারী সংস্থার নিয়ম-কানুন মেনে করা হচ্ছে।
# প্রকল্পটি থেকে পরিবেশ দূষণকারী কালো ধোঁয়া বের হবে না।
# কয়লা আবৃত অবস্থায় বহন করা হবে।
# কোনো দূষিত বা গরম পানি নদীতে ফেলা হবে না।
# কেন্দ্রের চিমনির উচ্চতা ২৭৫ মিটার হওয়ায় বাযু দূষণের আশঙ্কা নেই।
মোটের উপর এই যুক্তিগুলো তারা করেছেন।

প্রথমত, বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে আমাদের বিশেষ বক্তব্য নেই। সেটা সরকারের কথামতই পরিচালিত হয়, উপরন্তু সুন্দরবন সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের বন ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। উক্ত মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১২’-এর ১৩(২) নং ধারা অনুযায়ী ‘সকল ঐতিহ্যগত এলাকা ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে সরকার নিয়মনীতি বা নির্দেশিকা তৈরি করবে’ — একথা বলা হলেও আন্তর্জাতিকভাবে ঐতিহ্যগত স্থান হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আজ অবধি তৈরি হয়নি। অন্তত বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বই-পুস্তক ও ওয়েবসাইট ঘেঁটে আমরা কিছু বের করতে পারিনি। আবার কয়লাভিত্তিক শিল্পের ব্যাপারেও কোনো পরিবেশগত নিয়ম-নীতি এদেশে নেই। ফলে বন ও পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের বিশেষ কোনো মূল্য এখানে নেই। তাদের এ বিষয়ে কোনো বক্তব্যই নেই।

আর আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণকারী সংস্থা বলতে তারা কাদের বুঝিয়েছেন আমরা জানিনা, নাম উল্লেখ করে বললেই ভাল হত। কারণ খোদ ইউনেস্কো এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেছে। বিরোধিতা করেছে ‘রামসার’। আর বাংলাদেশে কোনো নিয়ম না থাকলেও ‘ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহিত পরিবেশ সমীক্ষা’ বা ‘আই এ গাইড লাইন ম্যানুয়াল ২০১০’ অনুযায়ী, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে বন্যঞ্চল, উদ্যান বা জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকতে পারে না। যে ভারতীয় কোম্পানি ছাড়পত্র হাতে নিয়ে চিৎকার করছেন, খোদ নিজের দেশেই কেন তাদের ছাড়পত্র নেই সে ব্যাপারে তারা কিছু বলেননি।

দ্বিতীয়ত, পরিবেশ দূষণকারী কালো ধোয়া বের হবেনা কিংবা কোন দূষিত বা গরম পানি নদীতে ফেলা হবে না — সুনির্দিষ্ট কোনো যুক্তি প্রমাণ ছাড়া কথাগুলো কিছু আপ্তবাক্য ছাড়া আর কিছুই নয়। পরিবেশ দূষণে কয়লার ভূমিকা শীর্ষস্থানে। বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বড় ঘাতক কার্বন, যার বড় অংশই নির্গত হয় কয়লা থেকে। রামপালে কয়লা পুড়বে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন, প্রতিদিন ১৩ হাজার মেট্রিক টন। এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।

কয়লা ধোয়ার পর পানির সাথে মিশে তৈরী হয় আরেকটি বর্জ্য তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই এবং এই তরল উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। ছাই বা ফ্লাই এ্যাশকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকটে অ্যাশ পন্ড বা ছাইয়ের পুকুরে গাদা করা হয় এবং স্লারি বা তরল বর্জ্যকে উপযুক্ত ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দূষণ মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ছাই বাতাসে উড়ে গেলে, ছাই ধোয়া পানি চুইয়ে কিংবা তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মাটিতে বা নদীতে মিশলে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ঘটে।

এ সকল কারণেই আবাসিক এলাকা, কৃষিজমি এবং বনাঞ্চলের আশপাশে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার অনুমতি প্রদান করা হয় না। সম্প্রতি আমেরিকাতে প্রায় তিনশত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জার্মানিতে ৩.১ গিগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট আর কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ করা হবে। গোটা দুনিয়ায় কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাদ দেয়া হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি বেছে নেয়া হচ্ছে। ভারতে তিনটি রাজ্যে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।
আর ভারত যে ২৫ কিলোমিটারের উপরিউক্ত নীতিটি গ্রহণ করেছে, কোনো ক্ষতিই যদি না হত তবে এই আইন করার তাদের কি দরকার ছিল? এ ব্যাপারে একটি কথা তারা প্রায়শই বলছেন যে, এখানে সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহৃত হবে। তাতে দূষণ হবে না। এটি একটি ভুল কথা। সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করে দূষণ ১০ ভাগ কমানো যায়। এত বড় দূষণের ১০ ভাগ কমলেও তাতে লাভ বড় একটা কিছু হবে না। ভারতেও সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়, তাই বলে তারা তাদের ২৫ মিটারের সীমারেখাকে ১ মিটারও কমায়নি।

তৃতীয়ত, কয়লা আবৃত অবস্থায় বহন করা হবে বলে যে যুক্তিটি তারা দিয়েছেন তা খুবই সাদামাঠা। কয়লা থেকে অত্যধিক পরিমাণে কার্বন কণা নির্গত হয়, যা পরিবহনের সময় আশেপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আবার এই বিপুল পরিমাণ কয়লা জাহাজে পরিবহনের সময় যে শব্দ ও বর্জ্য উৎপন্ন করবে তা এই সুন্দরবনের নদী-নালা, খাল-বিলসহ গোটা পরিবেশকে দূষিত করবে। এর ফলে এখান জলজ প্রাণীগুলো নিশ্চিতভাবে হুমকির মধ্যে পড়বে। যেখানে বৃক্ষরোপণের মতো কর্মসূচিতে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কা করা হয় সেখানে তার ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহন কিভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে? কারণ সুন্দরবনের ভেতরে হিরণপয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত কয়লা আসবে বড় জাহাজে। আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত যাবে ছোট লাইটারেজ জাহাজে। আকরাম পয়েন্টে কয়লা লোড-আনলোড হবে। প্রতিদিন ১৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা এই প্রকল্পে লাগবে। এই বিপুল পরিমাণ কয়লা এই বিরাট পথে তাও লোড-আনলোডসহ কিভাবে ঢেকে পরিবহন করা হবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু বোঝা গেলনা। বাস্তবে তা করার কোনো উপায়ও নেই।

আমাদের মনে হয় চিমনির উচ্চতা নিয়ে আমাদের আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এটা একটা ছেলে ভোলানো যুক্তি।
কি কি প্রকারে এই প্রকল্প পরিবেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে তার বিস্তারিত আমরা আমাদের পূর্বের বুলেটিনে বলেছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হোতারা সবই জানেন। তারা কোন যুক্তিরই ধরে ধরে উত্তর করেননি। শুধু ‘কিছু হবে না’ — এই কথাটাই আমরা বারবার শুনে আসছি।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ’১৫ বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) রামপালে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে কোম্পানির কর্মকর্তা ও প্রশাসনের লোকজনের বাইরে মূলত সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিরাই ছিলেন। তারপরও সেখানে উত্থাপিত সকল প্রশ্নের জবাব কর্মকর্তারা দিতে পারেননি। বাস্তবে কোনো যুক্তিই তাদের হাতে নেই।

এ প্রকল্পে বিদ্যুতের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ইউনিট প্রতি ৮-৮.৫০ টাকা, যেখানে বর্তমানে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মূল্য ৪-৫ টাকা। এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০% অর্থ আসবে বিদেশি ঋণ থেকে, বাকি ৩০%-এর মধ্যে ভারত বহন করবে ১৫% আর বাংলাদেশ ১৫%। আর ওই ৭০ ভাগ ঋণের সুদ পরিশোধ এবং ঋণ পরিশোধ করার দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশের। অর্থাৎ ভারতের বিনিয়োগ মাত্র ১৫ ভাগ, কিন্তু তারা মালিকানা পাবে ৫০ ভাগ।

আসলে ভারতের সাথে ট্রানজিট সংক্রান্ত আলোচনার মতো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও মহাজোট সরকার ভারতের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় জাতীয় স্বার্থে ছাড় দিচ্ছে। আমাদের নদীগুলো ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা চলছেই। এখন বাংলাদেশ ভারতকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় যোগাযোগের জন্য ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র এবং বাংলাদেশের শাসকদের জনবিরোধী সাম্রাজ্যবাদের প্রতি নতজানু নীতিই রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
তাই প্রকাশিত বিবৃতিটিও লোক দেখানো ও দায়সারা গোছের। গণতান্ত্রিক বামমোর্চা নির্মম রাষ্ট্রিয় বাধা মোকাবেলা করে রোর্ডমার্চ সফল করার মধ্য দিয়ে জনগণের দৃষ্টিতে যখন বিষয়টি আবার নিয়ে এসেছে, মানুষের দিক থেকে প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে, জনগণ জবাব চাইছে — তখন চাপে পড়ে বিক্ষিপ্ত, অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু কথা তারা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করে বিভ্রান্তি তৈরি করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

সাম্যবাদ অক্টোবর-নভেম্বর ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments