Friday, April 26, 2024
Homeফিচারশ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও উন্নয়নের ফানুস

শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও উন্নয়নের ফানুস

‘দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর’ খ্যাত শ্রীলংকায় অর্থনৈতিক ধ্বস ও এর প্রতিক্রিয়ায় গণবিক্ষোভ সম্প্রতি বহুল আলোচিত। শ্রীলংকার অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশের মিল-অমিল নিয়ে প্রচুর বিতর্ক চলছে। পাকিস্তানেও অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেপথ্য হস্তক্ষেপে সংসদীয় পন্থায় ইমরান খান সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশে গত দুই মেয়াদে জনগণের ভোট ছাড়াই ক্ষমতাসীন স্বৈরতান্ত্রিক ও দুনীর্তিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ সরকার কিছুটা অস্বস্তিতে। গত এক যুগের ‘উন্নয়ন’-এর সাফল্য যেভাবে প্রচার করা হয়েছে ও হচ্ছে, তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন বিপর্যস্ত, ধনী-গরিবের আকাশচুম্বী বৈষম্য প্রকটভাবে দৃশ্যমান, কোভিড মহামারীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীব-মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক দুর্দশা, স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা একেবারে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি, বিপুল ঋণভার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, রেমিট্যান্স হ্রাস, ডলার সংকট, চাকচিক্যপূর্ণ অপ্রয়োজনীয় মেগাপ্রকল্প, ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ-অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার, কালো টাকা, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, এলডিসি উত্তরণের ফলে চ্যালেঞ্জ–এসব নিয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতিসংশ্লিষ্টরাও উদ্বিগ্ন।

 

শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ : উন্নয়নের একই নীতি

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মুনাফাভিত্তিক। সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনই এখানে উৎপাদনের মূল উদ্দেশ্য। ফলে এই ব্যবস্থায় বৈষম্য থাকবে, অর্থনীতিতে মন্দা আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে একটা দেশ যখন এ ধরনের সংকটে পড়ে যে তার রিজার্ভ তলানীতে, রিজার্ভ না থাকার কারণে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য বাইরে থেকে সে আমদানি করতে পারছে না, দেশে খাদ্য সংকট চলছে, জ্বালানী আমদানি করতে না পারার কারণে দিনে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না, শিশুখাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে–তখন পুঁজিবাদী অর্থনীতির কোন নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে এই আপেক্ষিক ভারসাম্যও থাকলো না, সে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের সাথে তুলনামূলক আলোচনা আসছে কেন?

 

এই তুলনামূলক আলোচনা আসার কারণ অনুসন্ধানের আগে আমরা শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কী কী পদক্ষেপ ভূমিকা রেখেছে সেটা আলোচনা করি।

 

১. শ্রীলঙ্কা সরকার জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় খাতকে বাদ দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ করেছে। নেয়া হয়েছে রাস্তা, ফ্লাইওভার তৈরির বড় বড় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। আর এজন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়েছে বন্ড ছেড়ে। যে ঋণ এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগে আজ এইসকল অবকাঠামো তৈরিকেই উন্নয়ন বলে ধরা হয়। শ্রীলঙ্কাও বিশ্বায়নের সেই তথাকথিত উন্নয়নের ফাঁদে পা দিয়েছে।

২. এই বড় বড় প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থের একটা বড় অংশ লুটপাট হয়। এই লুটপাটের মাধ্যমে ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিগোষ্ঠীর পুঁজি বাড়ে, আর জনগণের কাঁধে ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকে। এই ধরনের প্রকল্প নিতে গেলে ও বাস্তবায়ন করতে গেলে কর্তৃত্ববাদী শাসন দরকার। শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবার অনেক বছর ধরে সে দেশের ক্ষমতায় আছে। তারা গোটা দেশের প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রের একচ্ছত্র অধিপতি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বড় ভাই এতদিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরিবারের ৭ জন সদস্য মন্ত্রিত্বসহ অন্যান্য সরকারি পদ অলংকৃত করে ছিলেন। ফলে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। একইসাথে তারা নিজেরাসহ সরকারি পদে থাকা অন্যরা বেআইনি সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

৩. কৃষিতে রপ্তানীনির্ভর ফসলের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যায়। নিজে কত পরিবেশবান্ধব এটা দেখাতে গিয়ে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে সকল প্রকার কেমিক্যাল সারের উপর সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই অপরিকল্পিত পদক্ষেপে দেশে কৃষি ফসল বিশেষ করে ধান ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে অক্টোবরে তিনি এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন এবং রাসায়নিক সার আমদানির জন্য বেসরকারি মালিকদের ছাড়পত্র দেন। একইসাথে কৃষকদের সারের উপর দেয়া ভর্তুকি তুলে দেন। এই ধাক্কায় দেশের ৫ লক্ষেরও বেশি কৃষিজীবী মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যায়।

৪. কোভিড পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কায় সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেয়া হয়নি কিন্তু পুঁজিপতিদের দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বিপুল পরিমাণ কর ছাড় দেয়া হয়েছে। পর্যটনখাতে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের ৬০ শতাংশ কর ছাড় দেয়া হয়েছে। এই গোটা সময়ে তাদের গায়ে কোন আঁচড় লাগেনি। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে শ্রীলঙ্কার শীর্ষ ৯ জন ধনকুবেরের আয় হয়েছে ৩৬৪ বিলিয়ন শ্রীলঙ্কান রুপি। তাদের মুনাফা বেড়েছে ১৮৯ শতাংশ। অথচ শূন্য হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার।

অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে আরও কিছু কারণ আছে। যেমন অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো ও অন্যান্য। সেগুলো বিস্তারিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এসেছে। আমরা এই প্রধান কয়েকটি কারণ নিয়েই আলোচনা করবো।

 

কেন শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশই বেশি আলোচিত

প্রথমত, বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতোই একের পর এক অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের বড় বড় প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক ইকোনমিক ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি। অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম তাঁর একাধিক লেখা এবং আলোচনায় এরকম কিছু প্রকল্পের উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ করেছে যে প্রকল্পে সেটি হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এক লাখ তেরো হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার ঋণ নির্ভর এই প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় ছিলো। অন্য উৎস থেকে এর চেয়ে কম ব্যয়ে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ড. মইনুল আরো দুইটি প্রকল্পের কথা বলেছেন, যেগুলো অর্থনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয় এবং আত্মঘাতী। এর মধ্যে আছে পদ্মা সেতু দিয়ে চীনের ঋণে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল লাইন টেনে নেয়া। তিনি দেখিয়েছেন স্থলপথের সাথে পাল্লা দিয়ে এই রেল লাইন প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কোনোদিনই লাভবান প্রকল্প হিসেবে দাঁড়াবে না। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন, যেটি চীনের কিউমিন পর্যন্ত যাবার একটা প্রকল্প ছিল। কিন্তু সেটি  থেকে ভারত বেরিয়ে যাওয়ায় তের হাজার কোটি টাকার ঋণ নির্ভর এই প্রকল্পও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সাদা হাতি হবে বলে ড. মইনুল মনে করেন।

 

প্রকল্পগুলো জনগণের জীবনমান উন্নতির বিচারে অপরিকল্পিত হলেও, সরকার ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্য খুবই পরিকল্পিত। এ প্রসঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কথা আলোচনা করা যায়। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা না বাড়িয়ে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলার জন্য ২০০৯ সালে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হলো। এই বিদ্যুকেন্দ্রগুলো স্থাপন করলেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা, এদের অনেকে এখন সরকারি দলের সাথে সরাসরি যুক্ত। সরকার তাদের সাথে চুক্তি করলেন যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর যতটুকু সক্ষমতা তার বিপরীতে প্রতি মাসে তাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাড়া দেয়া হবে। উৎপাদনক্ষমতার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ যদি তাদের উৎপাদন করতে নাও হয় তবুও সেই ভাড়া মাসে মাসে দিতে হবে। রাতারাতি গজিয়ে উঠা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা দেশের বিদ্যুতের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। আবার সক্ষমতার পরিপূরক জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তির জন্য সঞ্চালন লাইনও সরকার তৈরি করেনি। ফলে কখনও প্রয়োজন হলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে, কিন্তু জাতীয় গ্রিডে এই বিদ্যুৎকে সংযুক্ত করতে পারবে না। ফলে এই সক্ষমতা পুরোপুরি অকার্যকর। এই বাড়তি সক্ষমতার খরচ বহন করছে দেশের জনগণ। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো অলস হয়ে বসে থাকছে। গত অর্থবছরে, সরকার (বাস্তবে করদাতা জনগণ) ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সক্ষমতার খরচ হিসেবে এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে দিতে বাধ্য হয়েছে, যা কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের খরচের চেয়ে বেশি। এর আগের বছর, এই পরিমাণটি ছিল ৮ হাজার কোটি টাকা যা পায়রা সমুদ্র বন্দরের মোট খরচের অর্ধেক। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরও উড়োজাহাজ নিয়ে। তাদের এক সময় গন্তব্যসংখ্যা বেশি ছিল, সে তুলনায় উড়োজাহাজ ছিল কম। কিন্তু এখন তাদের অনেকগুলো উড়োজাহাজ, কিন্তু সে তুলনায় গন্তব্যসংখ্যা কম। একটু সচেতন, শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই প্রশ্ন আসবে, ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে নতুন দুটি ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ কেনার সময় কি কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো ভালো করে ভেবে দেখেননি?

 

ভেবে না দেখার কিছু নেই। তারা ভেবেছেন। ভেবেছেন এখান থেকে তাদের লাভ কত হতে পারে। যত বড় প্রজেক্ট, সেটা কনস্ট্রাকশনই হউক আর কেনাকাটাই হউক, তত বেশি কমিশন, তত বেশি লাভ। শীর্ষ ১০টি মেগা প্রজেক্টের তিনটি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মহেশখালী-মাতারবাড়ী উন্নয়ন প্রকল্প। এ তিনটির উপযোগিতা নিয়েই প্রশ্ন আছে, তার উপর এই প্রকল্পগুলোর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশের উপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব আছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের সক্ষমতার বাইরে, এটা পরিবেশের জন্য হুমকি। এ নিয়ে প্রচুর কথা এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। রামপাল প্রকল্প সুন্দরবন ধ্বংস করবে। এটি নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু সরকার কোন কিছুই কানে তুলেনি। কারণ তাদের হিসেবগুলো অন্যরকম।

 

এই প্রকল্পগুলোর ফলাফল কী? এক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাবদ রাশিয়ার কাছে ঋণ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সিপিডি এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, ২০০২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এই ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৪ শতাংশ। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বেড়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক দশকে দেনার পরিমাণ এর আগের দশক থেকে দেড়গুণ বেড়েছে।

 

সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লুটপাট ও দুর্নীতি। এই ঋণবৃদ্ধির হার অতি ধনী বৃদ্ধির হারের সাথে সমানুপাতিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতিধনীর সংখ্যাবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। খেয়াল করুন, ২০১২ সাল থেকে বাৎসরিক ঋণবৃদ্ধির পরিমাণও বেড়েছে।

 

ফলে এটা স্পষ্ট যে, এই প্রকল্পগুলো নেয়ার পেছনে একটা প্রকল্প আছে। যারা এই টাকা লুটপাট করে ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নিলেন তারা তো নিলেন, এখন এই বিপুল পরিমাণ ঋণের ভবিষ্যৎ কী? ২০২৫ ও ২০২৬ সাল থেকে মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলামের মতে, ঋণের কিস্তি ২০২৫ সালের মধ্যেই ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এটা শুধু বৈদেশিক ঋণ। এর সঙ্গে বিশাল অভ্যন্তরীণ ঋণ যুক্ত আছে। সেটা যোগ করলে বাংলাদেশের ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ৫০ শতাংশের উপরে চলে যাবে। এই বিপজ্জনক অবস্থার দিকে আমরা দ্রুত এগোচ্ছি।

 

ফলে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো নয়, বাংলাদেশের সেরকম কিছু হবে না–সরকারি এই ভাষ্য পায়ের নিচে মাটি পাচ্ছে না। এই আশ্বাসের পাশাপাশি সরকার তিনটি নির্দেশ জারি করেছেন যা এই আশ্বাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকার বিলাসদ্রব্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে বলেছেন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এই পদক্ষেপগুলো খুব স্পষ্টভাবে রিজার্ভ সংকটকে নির্দেশ করে। দেশে ক্রমাগত বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়া, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া ইত্যাদির পাশাপাশি দুই বছর পরে যখন ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে তখন পরিস্থিতি কোথায় যেতে পারে তা অনুমান করা যায়।

 

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্ত অবস্থান বোঝানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। জিডিপি কিংবা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির যে হিসাব সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়, সেটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে খুব সামান্যই ইঙ্গিত দিতে পারে। শ্রীলঙ্কায় দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালের মধ্যে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছিল। ১৯৯২ থেকে ২০০৪ এই ১৪ বছরে রপ্তানি-জিডিপির অনুপাতও বৃদ্ধি পেয়েছিল। একসময় জিডিপি ৯ শতাংশ হারেও বেড়েছে। শ্রীরঙ্কার মাথাপিছু আয়ও বাংলাদেশ থেকে বেশি ছিলো, প্রায় ৪ হাজার ডলার। কিন্তু কোন লাভ হয়নি এতে। একদিকে পুঁজিবাদী শোষণের অবশ্যম্ভাবী ফল দুর্নীতি ও লুটপাট, অন্যদিকে একটিমাত্র রপ্তানীখাতের উপর অতিনির্ভরতা ডলারের রিজার্ভ কমিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। একই পরিস্থিতি বাংলাদেশেরও। গার্মেন্টস ও প্রবাসী রেমিট্যান্সই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত। ফলে এক্ষেত্রে ধ্বস নামলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নামা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

 

তৃতীয়ত, এই প্রকল্প ও কেনাকাটা থেকে লুটপাটের ফলে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দেশে শুধু প্রকল্পের অর্থ নয়, ব্যাংক থেকেও হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে এবং বিদেশে পাচার হচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে একটা অবৈধ সরকার এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে। পলাতক পুঁজি (capital flight) সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনাকারী সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) জানাচ্ছে যে, এখন প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৭ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে এই ধরনের নৈরাজ্য ও অর্থ পাচার শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটার গতিকে ত্বরান্বিত করছে।

 

চতুর্থত, এ সমস্ত কিছু সহজে সম্ভব হয়েছে কারণ শ্রীলঙ্কার মতোই একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসকরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। শ্রীলঙ্কার বৃহৎ পুঁজিপতিরা যেমন রাজাপক্ষেদের সমর্থন দিয়েছে, অপরদিকে ঠিক তেমনি রাজাপক্ষে সরকার তাদের রক্ষা করেছে, তাদের পুঁজি ও মুনাফা বেড়েছে। এর তথ্য আমরা পূর্বেই দিয়েছি। বাংলাদেশে বৃহৎ পুঁজিপতিগোষ্ঠীর সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি এককেন্দ্রিক হওয়ার কারণে যে কোন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সরকারকে কোন বেগ পেতে হয় না।  একই পরিস্থিতি ছিল শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কায় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে ক্ষমতার যতখানি ভারসাম্য তৈরি হয়েছিলো, ২০ তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে সেটি বিলুপ্ত করে দেন এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করেন।  কর্তৃত্ববাদী শাসন, গণতন্ত্রহীনতা ও ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহার শ্রীলঙ্কার এই পরিণতিতে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে, যে চিত্র বাংলাদেশের সাথে অভিন্ন।

 

মিল আছে বলেই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আতঙ্ক ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য সেটা একটা ইঙ্গিত যে, এই ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পরিণতি কী হতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানেই নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, সংকট, নৈরাজ্য। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসন ও মেগা প্রকল্পভিত্তিক লুটপাট কত দ্রুত একটা দেশকে খাদের মধ্যে ফেলে দিতে পারে শ্রীলঙ্কা তার একটা দৃষ্টান্ত। আর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটা ইঙ্গিত।

সাম্যবাদ জুন ২০২২

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments