গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সম্প্রীতির প্রশ্নটি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দানে সমাবেশের পর বিষয়টি সামনে আসে। তারপর ৮ দফা দাবি, গেরুয়া পতাকা, জয় শ্রীরাম স্লোগান ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এটি সংবেদনশীল কিন্তু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা এ কারণে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। হিন্দু সম্প্রদায়ের সচেতন অংশকে ও সকল স্তরের গণতান্ত্রিক ও যুক্তিশীল মানুষকে খোলামনে আমাদের বক্তব্যটা ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব।
এই গণঅভ্যুত্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, আহত হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন। শহিদ দীপ্ত দে ছিলেন মাদারীপুর সরকারি কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, এই আন্দোলনে মাদারিপুরের প্রথম শহিদ তিনি। হাসিনার গণহত্যার প্রতিবাদেহবিগঞ্জের রিপন চন্দ্র শীল আড়াই মাসের সন্তান ঘরে রেখে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমে প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন তার ভাই শিপন শীল আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এখন আহত ও শয্যাশায়ী। গণঅভ্যুত্থানের স্ট্যালিনগ্রাদখ্যাত যাত্রাবাড়িতে প্রাণ দেন দুই সন্তানের পিতা সৈকত চন্দ্র দে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তারোয়া, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুদ্র সেন, ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপের কথা পত্রিকার পাতায় এসেছে বারবার।
অভ্যুত্থান পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ও বাসাবাড়িতে আক্রমণের কিছু ঘটনা ঘটেছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মাজারে হামলা হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। দেশের বেশিরভাগ মানুষই তা করেছে। আবার সে সময়ে আমরা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় পাহাড়া দিতে দেখেছি, এলাকায় এলাকায় টিম করে এলাকাবাসীকে পাহাড়া দিতে দেখেছি। একটা সম্প্রীতির পরিবেশ তখন গড়ে উঠেছিল।
আমরা তখন বলেছি যে, তিন ধরনের শক্তি এই কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। একটা হচ্ছে সুযোগসন্ধানী শক্তি, যারা কোনকিছু ঘটলেই সেখান থেকে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। আরেকটি হচ্ছে, পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি, যারা গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চলছেÑ এটা প্রমাণ করতে চায়। তারা এই ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নেমেছিল। তৃতীয়ত, উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি, যারা সুযোগ পেলেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটায়।
এরমধ্যে আমরা তিনমাস অতিক্রম করেছি। বড় ধরনের কোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেনি। যে সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বী আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের লাঠিয়াল ছিলেনÑ তাদের বাসাবাড়িতে সেই উত্তাল সময়ে যে আক্রমণ হয়েছে, সেটাকে সংখ্যালঘুর উপর হামলা বলে ধরা যায় না। আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত মুসলমান ধর্মাবলম্বী লোকেরাও এই জনরোষের বলি হয়েছেন। এর বাইরে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, যেখানে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেগুলোর বিচার হওয়া উচিত।
অতি সম্প্রতি এ ব্যাপারে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একাংশের যে ভূমিকা আমরা দেখছি, সেটা নিয়ে আমাদের কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। এই অংশটি হিন্দু ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। তাদের মিছিলে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানও উঠছে। এই স্লোগানটি আগে কখনও উঠেনি। আর এটা সকলেই জানেন, ভারতে এটি হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির স্লোগান। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক স্লোগান, যা ভারতের অসাম্প্রদায়িক জনগণ প্রত্যাখ্যান করেন।
অভ্যুত্থানের পরপরেই ভারতের বিজেপি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বানানো গল্প আমরা প্রচার হতে দেখেছি। আমরা তষনও এর প্রতিবাদ করেছি। এগুলো সত্য ছিল, এখনও যা প্রচারিত হচ্ছে তা সত্য নয়। আমরা মনে করি, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের সবচেয়ে বড় সহযোগী ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ এই বিষয় নিয়ে অপপ্রচার করার মাধ্যমে বিশ্বের সামনে এই অভ্যুত্থানকে সাম্প্রদায়িক অভ্যুত্থান হিসেবে প্রমাণিত করতে চায়। তারা এ দেশের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট করে একটা হিংসাত্মক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ও দাঙ্গার জন্ম দিতে চায়। শোনা যায়, এ কাজে তারা ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করছে ও তাদের প্রচারযন্ত্রে ব্যাপক প্রচার করছে।
সমাজঅভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা পরাজিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তি এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সক্রিয়। সাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ হয়তো না বুঝেই এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন। আমরা তাদের ভেবে দেখতে বলব, হিন্দু ঐক্যের ডাক দেয়া মানে পরোক্ষভাবে মুসলিম ঐক্যেরও ডাক দেয়া। দীপ্ত দে, রিপন শীল, হৃদয় তারোয়ারা হিন্দু ঐক্যের জন্য প্রাণ দেননি, প্রাণ দিয়েছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এই ধরনের ধর্মভিত্তিক ঐক্য জাতীয় সংহতিকে দুর্বল করে, দেশকে বিভক্ত করে। এটা কোন গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য হতে পারে না। আর একটা দেশে সংখ্যালঘুরা কতটা নিরাপদ সেটা নির্ভর করে সেদেশে কতটুকু গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে তার উপর। বিভক্তির উগ্র স্লোগান গণতান্ত্রিক পরিবেশ নির্মাণে সহযোগী হয় না, আর সেই অগণতান্ত্রিক পরিবেশ আবার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার পরিবেশ অভ্যুত্থানের সময় দেশে তৈরি হয়েছিল- এই সময়ের পদক্ষেপগুলো তাকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে অনেক সহযোগী মনোভাবাপন্ন মানুষ বিরূপ হচ্ছেন- এটি কোনভাবেই কাম্য নয়।
ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন বিজেপি নগ্নভাবে মুসলিম বিরোধী হিন্দু ঐক্যের স্লোগান দিচ্ছে এবং মুসলিমবিরোধী প্রচার চালাচ্ছে। বাংলাদেশের এরকম কোন রাজনৈতিক দল হিন্দুবিরোধী, সংখ্যালঘুবিরোধী মুসলিম ঐক্যের স্লোগান আজও দেয়নি। হিন্দুদের বিরুদ্ধে নগ্নভাবে প্রচার এখনো চালায় নি।
সকল সরকারের আমলেই সাম্প্রদায়িকতা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারও হিন্দুদের বন্ধু ছিল না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী নয় বছরে (আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের নয় বছর), সারাদেশে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুদের উপর সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি হামলা হয়েছে। এর কোনটারই বিচার হয়নি। পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার কোন ঘটনার বিচারও আওয়ামী লীগ করেনি, যদিও সেদিন তাদের কান্নায় চারপাশের সকল শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছিল।
সাম্প্রদায়িকতা এই উপমহাদেশে একটি বড় সমস্যা। এটা মোকাবেলা ও নির্মূলের পথ সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া নয়, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাকে শক্তিশালী করা। কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভূমিকার জন্য সাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সমাজে বিদ্বেষ বাড়ছে। ইসলামী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো যে কাজগুলো করে, একই ধরনের পাল্টা হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন ও স্লোগান দিয়ে সাম্প্রদায়িতা মোকাবেলা করা যাবেনা। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চিন্তা ও সংগঠনের প্রসার ঘটিয়েই সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করতে হবে।
একথা আমাদের মনে রাখা দরকার যে, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দুর্নীতি-লুটপাট-স্বজনপ্রীতি, শিক্ষা-চিকিৎসাকে দুর্মূল্য করে দেয়া- ইত্যাদি জনজীবনের সকল জ্বলন্ত সমস্যা মুসলমান-হিন্দু-সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে সমানভাবে আক্রান্ত করছে এবং সকলেই এ কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। জনজীবনের সমস্ত সমস্যা সকল সম্প্রদায়ের মানুষকেই আক্রান্ত করে। এই সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই ও তার মাধ্যমে এই ব্যবস্থাটা পরিবর্তনের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হতে পারে।
ঐক্যবদ্ধভাবে জনজীবনের সাধারণ সংকটগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠা সম্ভব- এটা অন্য কোন উপায়ে সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় আপামর শোষিত জনগণ তথা শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।গণঅভ্যুত্থানে গড়ে উঠা ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি সেটা আরেকবার প্রমাণ করেছে।