শ্রমিক গণহত্যার জন্য দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, হতাহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ এবং শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও নিরাপত্তা, ২৪ এপ্রিল সব কারখানায় ছুটি ঘোষণা ও দিনটিকে গণহত্যা দিবস পালনের দাবি জানিয়ে পালিত হল রানা প্লাজা শ্রমিক গণহত্যা দিবস। রানা প্লাজা শ্রমিক গণহত্যাসহ সকল শ্রমিক হত্যার বিচার, দায়ী ভবন ও গার্মেন্টস মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নিহত-আহত শ্রমিক পরিবারকে ৪৮ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ, আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসহ শ্রমিকদের জীবন ও কাজের নিরাপত্তা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের দাবিতে গাজীপুর থেকে রানা প্লাজা পর্যন্ত পদযাত্রা করেছে বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন। সকালে গাজীপুর চৌরস্তায় মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে পদযাত্রা শুরু হয়ে কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, জামগড়া, বাইপাইল, নবীনগর (জাতীয় স্মৃতিসৌধ) এলাকায় মিছিল ও সমাবেশ করে পদযাত্রা বিকাল পৌনে ৫টায় রানা প্লাজার
সামনে পৌঁছায়। এখানে প্রথমে শহীদ শ্রমিকদের স্মরণে নির্মিত শহীদবেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও পরে শ্রমিক সমাবেশের মাধ্যমে পদযাত্রা সমাপ্ত হয়।
সকাল ১০টায় চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের সামনে থেকে মিছিলসহ চৌরাস্তা প্রদক্ষিণ করে পরিবহন মালিক সমিতির অফিসের সামনে পদযাত্রার উদ্বোধনী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি মসিউর রহমান খোকন। এখানে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কমরেড জহিরুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি কমরেড সাইফুজ্জামান সাকন, জেলা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম। সমাবেশ পরিচালনা করেন শাহ জালাল। সকালে পদযাত্রা শুরুর সময় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন শ্রমিক বিক্ষোভের আশঙ্কার কথা বলে পদযাত্রায় বাধা দেয়ার চেষ্টা করে।পদযাত্রার দ্বিতীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কোনাবাড়ীতে। এখানে বক্তব্য রাখেন শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সংগঠক কমরেড কল্যাণ দত্ত, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য নাঈমা খালেদ মনিকা, ফেডারেশনের কোনাবাড়ী-কাশিমপুর শিল্পাঞ্চল শাখার সংগঠক দেলোয়ার হোসেন।
পদযাত্রার পরবর্তী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কাশিমপুর বাজারে। কাশিমপুর আঞ্চিলক শাখার সংগঠক চন্দন কুমার মোদকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড উজ্জ্বল রায়, আবু নাঈম, মসিউর রহমান খোকন।
এরপর পদযাত্রা সমাবেশে মিলিত হয় জামগড়া ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে। এখানে স্থানীয় সংগঠক মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কল্যাণ দত্ত। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে সমাবেশ না করার জন্য বাধা দেওয়া হয়। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করেই সেখানে সমাবেশ হয়।পদযাত্রার পরবর্তী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় বাইপাইল মোড়ে। এখানে বক্তব্য রাখেন সাইফুজ্জামান সাকন, নাঈমা খালেদ মনিকা। এরপর নবীনগর জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক মশিউর রহমান, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফ্রন্ট সংগঠক জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী, ছাত্র ফ্রন্ট গাজীপুর জেলার সংগঠক মনিরুল ইসলাম, ফেডারেশনের গাজীপুর জেলার সংগঠক ফরিদা ইয়াসমিন নাইস, ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক শরীফুল ইসলাম, ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সংগঠক কল্যাণ দত্ত।
এসব সমাবেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কাজ করতে বাধ্য করে হাজারো শ্রমিকের হত্যাকারী ভবন মালিক ও গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে অবিলম্বে বিচার সম্পন্ন করা, নিহত-আহত শ্রমিকদের আজীবন আয়ের সমান ৪৮ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ, সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন, ২৪ এপ্রিল গার্মেন্টস সেক্টরে ছুটির দিন ঘোষণা করা, কর্মস্থলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিম্নতম ৮০০০ টাকা মূল মজুরি নির্ধারণ ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের দাবিতে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।বিকাল পৌনে পাঁচটার সময় পদযাত্রা রানা প্লাজা এলাকায় পৌঁছে। এখানে প্রথমে ২৪ এপ্রিল গণহত্যার শিকার শ্রমিকদের স্মরণে নির্মিত শহীদবেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর পদযাত্রার সমাপনী সমাবেশে জহিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন উজ্জল রায়, কল্যাণ দত্ত, মসিউর রহমান খোকন।
সমাবেশে কমরেড জহিরুল ইসলাম বলেন, বিগত বিএনপি আমলে এই সাভারেই স্পেকট্রাম ভবন ধসে সরকারি হিসাবে ৩ শতাধিক, আর শ্রমিকদের হিসাবে কমপক্ষে ৭ শত শ্রমিক নিহত হয়েছিল। আজ পর্যন্ত সে ঘটনার বিচার হয়নি, শ্রমিক পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পায়নি। আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের আমলে তাজরিন ফ্যাশন্সে আগুনে পুড়ে ১১৩ জন শ্রমিক কয়লা হয়ে গেল। তার কি বিচার হয়েছে? শ্রমিকরা কি ক্ষতিপূরণ পেয়েছে? উত্তর হল না। রানা প্লাজার সরকারি হিসাবে ১১৩৪ জন শ্রমিক মারা গেল, ১৩৪ জন এখনো নিখোঁজ। আসলে মারা গেছে আরো বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতবড় গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি। এক বছর পার হল। এখনো বিচার হয়নি। শ্রমিকদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, তাও বেশিরভাগ শ্রমিক পায়নি। এসব ঘটনা একটাই সত্য প্রমাণ করে। আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী, সে আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক, জামাত হোক, জাতীয় পার্টি হোক – তারা শ্রমিকের স্বার্থ দেখে না। তাহলে তারা কার স্বার্থ দেখে? তারা দেখে মালিকের স্বার্থ। মালিকের স্বার্থ রক্ষা করতে তারা শ্রমিকের ওপর গুলি চালায়। এ সত্যটা আজ শ্রমিকদের বুঝতে হবে।
কমরেড উজ্জল রায় বলেন, আমরা যে সমাজে, যে রাষ্ট্রে বাস করি, এই ব্যবস্থার নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যবস্থার নাম মালিকী ব্যবস্থা। এখানে মালিকের স্বার্থের জন্যই আইন, মালিকের জন্যই পুলিশ, আর্মি, র্যাব, মালিকের জন্যই সংসদ। শ্রমিককে শোষণ করে মালিক যাতে বড় লোক থেকে আরো বড়লোক হতে পারে, এখানে সেই ব্যবস্থাই করা হয়। তাহলে শ্রমিকের উপায় কি? শ্রমিকের স্বার্থ কিভাবে রক্ষা হবে? শ্রমিক কিভাবে তার দাবি আদায় করবে? শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার এই মালিকী ব্যবস্থা উৎখাত করে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আর সে লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী ধারার ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলা। বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের পতাকাতলে সমবেত হয়ে সে আন্দোলনে এগিয়ে আসার জন্য তিনি শ্রমিক-জনতার প্রতি আহ্বান জানান।