[প্যারিসের কার্টুন পত্রিকা শার্লি এবদোর দফতরে ৭ জানুয়ারি সন্ত্রাসীরা হানাদারি চালিয়ে খুন করেছে ১২ জন মানুষকে। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের ‘পোল অফ কমিউনিস্ট রিভাইভাল ইন ফ্রান্স’(পিআরসিএফ – ফ্রান্সে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে সম্মিলিত বামপন্থীদের সংগঠন) নিচের বিবৃতিটি প্রকাশ করেছে। ফ্রান্সেরই অপর একটি সংগঠন ‘কমিউনিসটেস’ প্রায় একই বিবৃতি প্রকাশ করেছে।]
যেন মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে উঠে এসে সন্ত্রাসবাদীরা নিরস্ত্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। হতবুদ্ধি সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ১২ জন নিহত, অনেকেই গুরুতর আহত। নিহতদের ঘনিষ্ঠজনদের যন্ত্রণা ও ঘৃণার শরিক আমরা। সমস্ত ধর্মের নাগরিক, যারা ধর্মনিরপেক্ষতার জয়গান করেন, চার্চের ভীতি ও সন্ত্রাস থেকে মানুষকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে একসময় ঈশ্বরনিন্দাকে আপরাধ হিসেবে গণ্য করার যে আইনটি বাতিল হয়েছিল, তা ফিরিয়ে আনার দাবির বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিল যাঁরা, তাঁদের সকলের দুঃখ ব্যথার আমরা শরিক। এই হামলায় যাঁরা নিহত হলেন তাঁদের সকলের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধা।
পিআরসিএফ এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায়। এইসব হত্যাকারী ও তাদের দীক্ষাগুরু, যাদের কোনওমতেই ক্ষমা করা যায় না, তাদের প্রতি রইল তীব্র ঘৃণা।
এরপর সমস্ত ঘৃণাবোধের ঊর্ধ্বে উঠে ঠাণ্ডা মাথায় আমরা এই ঘটনার বিশ্লেষণ করেছি এবং নিজেদের কাছে প্রশ্ন রেখেছি, এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কী আছে। এখনও পর্যন্ত হত্যাকারীরা কারা সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। তা সত্ত্বেও ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টির নেতা মারিন লে পেন এই হত্যাকা-কে ইসলামি মৌলবাদীদের হামলা বলে নিন্দা করেছেন। এই অনুমানটিকে আপাতভাবে যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও, এটা কিন্তু অনুমান ছাড়া কিছু নয়। এবং ন্যাশনাল ফ্রন্টের এই মন্তব্যের মধ্যে প্ররোচনা আছে। তাদের আশা, এই অনুমান প্রচার পেলে তাদের বিদেশাতঙ্ক ছড়ানোর কার্যক্রম গতি পাবে।
ধর্মীয় মৌলবাদীদেরই যে শুধু সন্ত্রাস ছড়ানোর একচেটিয়া অধিকার আছে, তা নয়। ইসলামি মৌলবাদীদের কথাই যদি ধরা হয়, কারা তাদের উৎসাহ জোগাল? কারাই বা তাদের অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে? কারা তাদের সমর্থন করছে?
এ কাজ করছে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলি, যেমন – সৌদিআরব, কাতার এবং যুদ্ধ জোট ন্যাটোর অনুগত আরব দেশগুলো। এরাই আরবের কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, সেখানকার শ্রমিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলিকে ভাঙতে কাজে লাগিয়েছে এসব মৌলবাদীদের। আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকার আন্তর্জাতিক বিধি মেনে যে লালফৌজকে সাহায্যের জন্য ডেকে এনেছিল, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনকে মদত দিয়েছিল। মনে রাখা দরকার, মিশরের আনোয়ার সাদাত নিজের দেশের প্রগতিশীল মানুষদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডকে। আজও সাম্রাজ্যবাদীরা স্বাধীন ও সার্বভৌম সিরিয়ার বিরুদ্ধে আইএসআইএস-কে অস্ত্র ও অর্থ জুগিয়ে চলেছে। একথা মনে রাখা দরকার, লিবিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে কারা নৃশংসভাবে খুন করে দেশটিকে মৌলবাদী র্ধমান্ধদের হাতে তুলে দিয়েছে। এরা হলো ফ্রান্সের তৎকালীন প্রধান সারকোজি, বৃটেনের ক্যামেরন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা।
বাস্তবে, ইসলামী মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদেরই সৃষ্টি, যা অনেক সময় নিজের সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে যায়। আনোয়ার সাদাতকে মুসলিম ব্রাদারহুডের হাতেই মরতে হয়েছিল। আফগানিস্তানের হাজার হাজার ছাত্র, কমিউনিস্ট কর্মী ও শিক্ষকদের হত্যা করার পর তালিবানরা পশ্চিমী দেশগুলির দিকেই তাদের অস্ত্রের মুখ ঘুরিয়ে ধরেছে, তারা ধ্বংস করেছে আমেরিকার টুইন টাওয়ার।
এইসব জঘন্য অপরাধ থেকে কারা সুবিধা পায়? এটাকেও অবশ্যই আলোচনার বিষয় করা উচিত। কোন্ সেই রাজনৈতিক শক্তি যারা আরববিরোধী জাতিবিদ্বেষ মদত দিচ্ছে? কারা শ্রেণীসংগ্রামের বাস্তবতাকে সরিয়ে সেই জায়গায় জাত-পাত-ধর্মের লড়াইকে সামনে আনতে চাইছে? এরা হলো উন্মত্ত ফ্যাসিবাদী শক্তি, যাদের মধ্যে আছে দক্ষিণপন্থীরা যারা ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন নিয়ে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের জাতি-ধর্ম বিদ্বেষী প্রচারের শরিক হচ্ছে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের বিরুদ্ধে নিন্দা ছড়ানোর ফলে খেটে খাওয়া সাধারণ মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে অনেকে। এ জিনিস অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার, নাহলে এর পরিণতিতে ফ্রান্স এবং গোটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জুড়ে ফ্যাসিবাদ কায়েম হবে।
এই ভয়ংকর পরিবেশ তৈরির পিছনে ফ্রান্সের অল্যান্দে সরকারের অপরাধ কিছু কম নয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ন্যাটোর শরিক হিসেবে এই সরকার পূর্বতন সারকোজি সরকারের চেয়েও কয়েকধাপ এগিয়ে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে, ইসরায়েলের খুনি প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহুকে সমর্থন জানাচ্ছে, আইভরি কোস্ট, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও মালির মতো আফ্রিকার দেশে দেশে নয়া উপনিবেশবাদী হস্তক্ষেপে মত্ত হয়েছে। আমরা বারবার বলে এসেছি, ফ্রান্সে ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামটি ‘আমাদের নিজেদের’ দেশের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিদিন বন্য হিংসার জন্ম দেয়ার জমি তৈরি করছে।
এই উদ্দেশ্যে পিআরসিএফ ফ্যাসিবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণের ফ্রন্ট গড়ে তোলার ডাক দিচ্ছে, যে ফ্রন্ট সমাজ প্রগতি, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও প্রসারে এবং দুনিয়া জুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নেবে। কমিউনিস্টরা থাকবে এই লড়াইয়ের প্রথম সারিতে। নানা রঙের নানা দলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আসুন, আমরা প্রগতিশীল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করি। জনগণের সংগ্রামী ঐক্য, দৃঢ়তা এবং শোষণ, দারিদ্র্য, সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা ও যুদ্ধবিহীন সমাজ গড়ে তোলা, তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নই এই হত্যাকারীদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়াবে।
বিনা দ্বিধায় এইসব হত্যাকারী ও তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার পাশাপাশি শ্রেণীসংগ্রামকে তীব্রতর করা এবং ইউরোপ জুড়ে ব্যয়সংকোচের নীতির বিরুদ্ধতা করতে করতেই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিপদমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে হবে।
(সূত্র : গণদাবী, ২৩-২৯ জানুয়ারি ২০১৫, কলকাতা)