Friday, May 3, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি সংবাদমার্কিন পণ্য ও অস্ত্রের বাজার নিশ্চিত করে দিলেন মোদি

মার্কিন পণ্য ও অস্ত্রের বাজার নিশ্চিত করে দিলেন মোদি

nd24-Rallies_GO_DE_2288943g

[সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভারত সফরকে কেন্দ্র করে এই বিশ্লেষনটা ভারত থেকে প্রকাশিত গণদাবী ১৩-১৯ ফেরুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।] 

বহু কোটি টাকা ব্যয় করে বিজেপি সরকার পয়লা নম্বর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে দিল্লিতে আপ্যায়ন করল। ২৬ জানুয়ারি কুখ্যাত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারী রাষ্ট্রনেতাকে আপ্যায়ন করার দ্বারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গৌরব বোধ করেছেন নিশ্চয়, কিন্তু ভারতের পক্ষে এ ঘটনা চরম অগৌরবের, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ও শত শত শহিদ স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি নিদারুণ অপমান, তাতে সন্দেহ নেই। এজন্যই এস ইউ সি আই (সি) সহ ৬টি বামপন্থী দল সারা দেশ জুড়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ সংগঠিত করেছে।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শোনা গিয়েছিল তিনি মিডিয়াকে এড়িয়ে চলবেন। হয়তো অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়াতেই। কিন্তু মাকর্িন প্রেসিডেন্টের সাথে করমর্দনের ভঙ্গিমা থেকে ছাতা মাথায় হাঁটা, আলিঙ্গন ইত্যাদি সবকিছুই যেন সামনের ক্যামেরার সাথে মেপে পরিকল্পিত। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ‘বারাক’ বলে সম্বোধন করে নরেন্দ্র মোদি তাঁর সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘ঘনিষ্ঠতা’ বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু খেয়াল করেননি যে, ওবামার সাথে প্রত্যেকটি সাক্ষাতে তাঁর ঐ আকর্ণ হাসির সাথে গদগদ ভাব ক্যামেরাবন্দি হয়ে দেশবাসীকে বুঝিয়ে দেবে ওবামাকে ভারতে আনতে পেরে মোদি সাহেব যারপরনাই আহলাদিত ও বিগলিত। মোদি সাহেব বিগলিত হতেই পারেন, কারণ বিশ্বের এক নম্বর শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্টের সাথে দিল্লির বুকে দাঁড়িয়ে করমর্দন মোদির ‘স্ট্যাটাস’ বাড়াতে পারে অনেকের মধ্যে, মোদির ‘কূটনৈতিক সাফল্য’ নিয়ে বিজিপি শিবিরে ঢাক বাজাতে পারে। কিন্তু দেশের মানুষ কী পেল — এই প্রশ্নের জবাব তো ৯ লক্ষ টাকার পোশাক পরে ওবামার সাথে ‘ঘনিষ্ঠতা’র ছবি দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে না! যেমন বারাক ওবামাকে মোদি কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন — ভোপালে গ্যাস দুর্ঘটনার ৩১ বছর পার হয়ে গেলেও কেন মার্কিন সংস্থা ইউনিয়ন কার্বাইড ক্ষতিগ্রস্থদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিল না? ওবামা কি জানিয়েছেন, কেন ঐ সংস্থাকে ভারতে এনে আদালতে বিচার করা গেল না? অথচ এগুলি তো মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি বারতবাসীর দাবি ছিল! তাহলে প্রধানমন্ত্রী মোদি কি ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্ব করলেন?

ওবামার সফর শেষে ৩৬ পাতার যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ছত্রে ছত্রে লেখা হয়েছে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে দুই দেশের আমলাদের মধ্যে কত বৈঠক ও মতবিনিময় হয়েছে। শান্তি, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে কত শত কথা হয়েছে। কিন্তু এসবের নিট ফল কী? কথা হয়েছে, মার্কিন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি ভারতকে ২ হাজার কোটি ডলার দেবে। আমেরিকার ওভারসিজ প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট দেবে ১ হাজার কোটি ডলারের একটি প্যাকেজ। আমেরিকার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাঙ্ক ও ভারতের অপ্রচলিত বিদ্যুৎ সংস্থার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত পাবে ২ হাজার কোটি ডলারের একটি প্যাকেজ। পরমাণু চুল্লি বিক্রির জন্য ব্যগ্র মার্কিন পুঁজিপতিরা হঠাৎ ওবামার মাধ্যমে ভারতে অপ্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এত ব্যস্ত কেন? কারণ একটাই। অপ্রচলিত বিদ্যৎ উৎপাদনের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার তা-ও আমেরিকার কোম্পানিগুলি ভারতকে বেচবে।

পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত ‘সমঝোতা’ই এবারে সফরের সবচেয়ে ‘বড় প্রাপ্তি’ বলে সরকার দেখাতে চেয়েছে। আসলে সেটা কী ‘প্রাপ্তি’ তা বুঝে নিতে হলে ২০০৫ সালে বুশ-মনমোহন চুক্তির কথা একটু জেনে নেওয়া দরকার। এই পরমাণু চুক্তির মূল কথা ছিল, ভারতে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য মার্কিন কোম্পানিগুলি হাত বাড়িয়ে দেবে, জ্বালানি হিসাবে ইউরেনিয়াম সরবরাহ করবে তারা। আর মার্কিন সম্মতি পেলে তার বন্ধু দেশগুলিও জ্বালানি সরবরাহে রাজি হয়ে যাবে। এই চুক্তির প্রথম রূপরেখা বা খসড়া তৈরি হয় ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই। তিন বছর পর ২০০৮ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

USIS Protest Rally(240115)_Achyut (1)একে কেন্দ্র করে দেশে ভালোই আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তদানীন্তন কংগ্রেসের ইউপিএ সরকার ঐ চুক্তিকে বলেছিল ‘ঐতিহাসিক’। কারণ, যেসব দেশ আন্তর্জাতিক সিটিবিটি (কম্প্রিহেনসিভ টেষ্ট ব্যান টি্রটি) বা পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না, তাদের পরমাণু শক্তি উৎপাদনে আমেরিকা ও তার বন্ধু দেশগুলি সহায়তা দেয় না। ভারত ঐ সিটিবিটি-তে সই না করেও পরমাণু শক্তি উন্নয়নে আমেরিকার সাহায্য পাবে, এই নিশ্চয়তার জন্যই ভারত ঐ চুক্তিকে বলেছিল ঐতিহাসিক। সে সময় মনমোহন সিং ও জর্জ বুশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, পরমাণু শক্তি উৎপাদনে সামরিক ও অসামরিক ক্ষেত্রদুটিকে ভারত সম্পূর্ণ আলাদা করে দেবে। অপর শর্তটি হচ্ছে, পরমাণু চুল্লিগুলি যেহেতু মার্কিন কোম্পানিগুলি সরবরাহ করবে, সেজন্য সেগুলির উপর নজরদারি করার অধিকার থাকবে আমেরিকার। এই অধিকার নিয়েই কিছুটা হইচই হয়। বামপন্থী সিপিএম, সিপিআই ও আরও কিছু দক্ষিণপন্থী দলও এই শর্তের মধ্যে ভারতের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হওয়ার বিপদ দেখতে পায়। ১৯৯১ সালে আইএমএফ থেকে ভারতের শর্তাধীন ঋণ নেওয়ার সময়েও একই রকম কথা বলেছিল এইসব দলগুলো, যেন এ না হলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধতা করা যায় না।

কিন্তু এ প্রশ্নে এস ইউ সি আই (সি)-র অভিমত ছিল ভিন্ন। আমরা দেখাই যে, ভারত শুধু পুঁজিবাদী নয়, একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। এবং সুপারপাওয়ার হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে চলে ভারতের একচেটে পুঁজিপতিরা। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে বলে ভারতের এই ব্যগ্রতা, সেটা বাইরের মুখোশ। এ-ও জানা যে, ভারতের মতো দেশে বিপুল ব্যয়সম্পন্ন পরমাণু বিদ্যুৎ কার্যকরী হতে পারে না। আসলে, পরমাণু বিদু্যৎ উৎপাদনে আমেরিকা সহ পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়ার মাধ্যমে ভারত পরমানু অস্ত্র তৈরির ভারতীয় ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক সিলমোহর লাগাতে চায়।

পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে বোমা ও অস্ত্র তৈরির দূরত্ব সামান্যই। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে যে তেজষ্ক্রিয় মৌলগুলি উৎপন্ন হয়, তাকে সহজেই পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য পুনর্ব্যবহার করা যায়। যাই হোক, ভারত যে একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র, এ কথা সমগ্র বিশ্ব জানে, পরমাণু বোমার পরীক্ষা ভারত কম করেনি। কিন্তু তার প্রয়োজন মাকর্িন স্বীকৃতির। তাহলেই মার্কিন-বন্ধু দেশগুলি থেকে জ্বালানি ইউরেনিয়াম পেতে সমস্যা হবে না তাই নয়, পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ নিয়ে ঢাক ঢাক গুড় গুড় করতে হয় না। সব মিলিয়ে ভারত রাষ্ট্রের সাইনবোর্ডে পরমাণু শক্তিধর সুপার পাওয়ার কথাটি প্রকাশ্যেই জ্বলজ্বল করতে পারে। মার্কিন স্বীকৃতি পাওয়া মানে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদীদের শিবিরে জুনিয়র পার্টনার রূপে স্বীকৃতি পাওয়া, যেটা দেখিয়ে ভারতের প্রকৃত শাসক একচেটে পুঁজিপতিরা এই উডমহাদেশীয় অঞ্চলে পেশি আস্ফালন করে বাজার দখলে নামতে পারে। এই নিরিখেই ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন বিচার করা দরকার।

এবারের সংবাদপত্রের ছবিতে দেখা গেল, ভারতীয় ধনকুবের একচেটে পুঁজিপতিরা রাষ্ট্রপতি ভবনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। এরাই কিন্তু ভারতের প্রকৃত শাসক। এরাই সরকারে কোনও দলকে বসায়, কোনও দলকে সরায়। সরকার হচ্ছে এদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার। এদের ব্যবসা ও মুনাফার দাঁড়িপাল্লাতে এ যুগে কোনও পুঁজিবাদী দেশের সার্বভৌমত্বের পরিমাপ হয়। এরা যে কোনও শর্তে মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীদের সখ্যতা চায়, কারণ ভারতীয় ধনকুবের গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য এখন ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বে প্রসারিত। আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, আমেরিকা — যারা যে শর্তই দিক, ভারতীয় পুঁজিবাদ তা মানে তার নিজের স্বার্থেই, দেশ ও জনগণের স্বার্থ এদের কাছে কোনও বিবেচনার বিষয়ই নয়।

যাই হোক, মনমোহন সিংয়ের সময়ে চুক্তি রূপায়ণে যা বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা হচ্ছে পরমাণু উৎপাদন কেন্দ্রে বিপর্যয় ঘটলে তার দায় কে নেবে। চেরনোবিল, ভোপাল গ্যাস কাণ্ড বিপর্যয়ের ভয়াবহতাকে সামনে নিয়ে আসে। ভোপাল গ্যাসকাণ্ডে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য মার্কিন কোম্পানি ইউনিয়ন কার্বাইড বা ডাও কেমিক্যাল কোনও দায়ই নেয়নি, ক্ষতিপূরণ দেয়নি, কোনও শাস্তিও হয়নি তাদের। এজন্যই মনমোহন সরকার ২০১০ সালে পার্লামেন্টে ‘পারমাণবিক দায়বদ্ধতা আইন’ পাশ করাতে বাধ্য হয়। এই আইন অনুযায়ী পরমাণু কেন্দ্রে কোনও বিপর্যয় ঘটলে তার দায় যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী কোম্পানিকে নিতে হবে, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও দিতে হবে। আমেরিকার বক্তব্য হল, এই শর্তের জন্যই তাদের কোম্পানিগুলি ভারতে পরমাণু চুল্লির ব্যবসা করতে আগ্রহ হারায়। মোদির ম্যানেজাররা দাবি করেছেন, এ বিষয়ে বাধা দূর করে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে দফায় দফায় অন্য দেশে গোপন বৈঠক করা হয়েছে। গোপন কেন? কারণ, জানাজানি হলে হইচই হতে পারে। অতএব জনগণকে অন্ধকারে রেখে কথাবার্তা হয়ে গেছে। কী চমৎকার স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা!

ওবামার সফর শেষে বলা হল, বিপর্যয়ের দায় বিদেশি কোম্পানিদের নিতে হবে না, তা মোটানোর জন্য একটা বিমা তহবিল তৈরি করা হবে। কিন্তু এখানেও আজও পর্যন্ত স্বচ্ছ ভাবে কিছু বলা হয়নি। এই তহবিলে টাকা দেবে কারা? ক্ষতিপূরণ কত, তা হিসাব করবে কারা? ভারতীয় বিমা কোম্পানি যদি এই দায় নেয়, তাহলে সে টাকা তো দেবে ভারতের জনগণ। তাহলে, মার্কিন কোম্পানির সরবরাহ করা পরমাণু চুল্লিতে বিপর্যয় ঘটলে ক্ষতিপূরণের টাকা ভারতের জনগণের ঘাড় ভেঙে নেওয়া হবে? কী চমৎকার ব্যবস্থা! ঠিক কী যে সরকার করেছে, ওবামা-মোদির বন্ধুত্ব কী ধরনের সমঝোতা প্রসব করেছে, তার সবটাই ধোঁয়াশা। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, ভারতকে অস্ত্র উৎপাদনে সাহায্য করার সূত্র ধরে ভারতের বাজারে মার্কিন অস্ত্র কোম্পানিগুলির পণ্য বেচার ব্যবস্থা করে দিলেন নরেন্দ্র মোদি। মার্কিন যুদ্ধ বিমান ও অন্যান্য যুদ্ধ সম্ভারের বাজারে মন্দা। অতএব ভারতের লোভনীয় বাজার পেতে ছুটে এসেছেন ওবামা।

তাহলে শিল্পের কী হল? মাকর্িন প্রেসিডেন্টের আপ্যায়নে ভারতের শিল্পের চাকা তরতরিয়ে এগোবে বলে যাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁরা ভারতের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো খুললেই দেখতে পাবেন, মন্দার পাঁকে ভারতের শিল্পরথ কীভাবে আটকে আছে। সেখান থেকে মুক্তির কোনও নাম-নিশানা নেই। পুঁজিবাদ আজ আর সেই নিশানা দিতে পারে না। কারণ স্বয়ং পুঁজিবাদই আজ মুমূর্ষু — মৃত্যুশয্যায়।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments