Thursday, April 25, 2024
Homeঅনুশীলনরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক কোর্স চালুর বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রশাসন-ছাত্রলীগ-পুলিশের ন্যাক্কারজনক হামলা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক কোর্স চালুর বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রশাসন-ছাত্রলীগ-পুলিশের ন্যাক্কারজনক হামলা

রাবিতে নাইটশিফট শিক্ষাবিস্তারের জন্য নয়, (অবকাঠামো ব্যবহার করে) ব্যবসার জন্য

969[dropcap]‘[/dropcap]পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি সাধারণ পাবলিকের জন্য নাকি পাবলিকের টাকায় ধনীর জন্য’ – এ নীতিগত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রচনা করল ন্যায়নিষ্ঠ ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি দৃষ্টান্ত। বাণিজ্যিক লক্ষ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেভাবে রাইফেলবাহী পুলিশ আর পিস্তলবাহী ছাত্রলীগ দিয়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্র্ণ সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তা কেবল বিবেকবান মানুষকে স্তম্ভিত করেনি, শিক্ষক সমাজের অতীতের সম্মান-গৌরবের আসনকে কলঙ্কিত করেছে। অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতির নামে আদর্শহীন অপরাজনীতির ধারাটিকে পুনরায় উন্মোচিত করেছে। পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছে, জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যারাই অবস্থান নেবে, তাদের চরিত্র কলুষিত হবেই, সে ছাত্র শিক্ষক যে-ই হোক। বারে বারে এদের অপকর্মের দায় ছাত্র রাজনীতির ঘাড়ে এসে পড়ে। কিন্তু এ কি রাজনীতি? তাহলে লাঠি গুলি টিয়ার গ্যাস উপেক্ষা করে যে হাজার হাজার ছাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শিক্ষার অধিকার রক্ষার লড়াই-এ শামিল হলো তারা কোন নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলো? তারা কি এই বার্তাই দিল না – অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মার খাওয়াটাই, রক্তাক্ত হওয়াটাই সত্যিকারের রাজনীতি? তাই আর মুখ বুজে থাকা নয়, দূরে দাঁড়িয়ে অপরাজনীতিকে কেবল ঘৃণা নয়, মানুষের দাবিকে উচ্চকিত করেই সত্যিকারের রাজনীতির উদ্বোধন ঘটবে। এবং এটাই হবে আগামী দিনের রাজনীতি।

ঘটনা পরম্পরা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৭টি বিভাগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নাইট কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং বিভিন্ন খাতে ২-৫ গুণ পর্যন্ত ফি বৃদ্ধি করা হয়। শুরুতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট প্রগতিশীল ছাত্রজোটের উদ্যোগে নাইটকোর্স বাতিল ও ফি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা হলেও পরবর্তীতে ‘বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স ও বর্ধিত ফি বিরোধী শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচী পালনের পর ৩০ জানুয়ারি থেকে লাগাতার ধর্মঘট পালিত হচ্ছিল। প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাবেশ চলাকালে ছাত্রলীগ সশস্ত্র মিছিল নিয়ে সমাবেশে হামলা চালালে ১২ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয় এবং শতাধিক আহত হয়। আন্দোলন স্তিমিত করতে সেই দিনই প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং ছাত্রদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। এরপর প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে ছাত্রজোট নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে ৬টি মামলা করা হয়। অথচ হামলাকারী অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ‘আত্মরক্ষার সুযোগ সকলের আছে’ বলে প্রকারান্তরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। স্পষ্টতই বোধগম্য, প্রশাসনের ইন্ধনেই এ ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ-প্রশাসনও তা স্বীকার করেছে।

প্রশাসন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য আড়াল করতে চাইছে
প্রশাসনের পক্ষ থেকে যুক্তি করা হচ্ছে- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি তো খুব সামান্য’, ‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এরচে’ অনেক বেশি ফি দিয়ে কি ছাত্ররা পড়ে না?’, ‘বিকেল ৫টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তো পড়ে থাকে’, ‘অবকাঠামো ব্যবহার করে আরো কিছু ছাত্র পড়ার সুযোগ পেলে কি অসুবিধা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া আরও একটি মুখরোচক কথা এরা চালু করেছে, ‘ছাত্ররা ১২/১৮ টাকা বেতনে পড়ে। এই ছাত্ররা মোবাইল-সিগারেটের পেছনে শত শত টাকা খরচ করে। আর ২/১ টাকা বেতন বাড়ানোর কথা বললেই আন্দোলনে নামে।’ আলাদাভাবে শুনলে কখনো মনে হবে কোন মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই বুঝি এ উদ্যোগ। ছাত্রদের মতের তোয়াক্কা না করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে যারা সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে, পুলিশ দিয়ে দমন করে তাদের উদ্দেশ্য কতটা মহৎ সে প্রশ্ন বাদ রেখেও বক্তব্যগুলোকে একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
imagesশিক্ষা বিস্তারই লক্ষ্য হলে সান্ধ্যকালীন কোর্সে বাড়তি ফি নেয়া হবে কেন? উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করলে তো রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করা হত অথবা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে আসন বাড়ানো হত। তা না করে একের পর এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে কেন? গত বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্মিলিতভাবে মুনাফা করেছে ১৮৫০ কোটি টাকা। যে কৃষক সারাদেশের মানুষের মুখের অন্ন জোগায় অথচ ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না, উদয়াস্ত শ্রমে যে শ্রমিক সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, খেয়ে না খেয়ে আর আগুনে পুড়ে, ভবন ধ্বসে মরে মালিকের কোটি কোটি টাকার সম্পদ বৃদ্ধি করে, তার বা তাদের সন্তানদের জন্য কি এ বিশ্ববিদ্যালয় নয়? জনগণ ট্যাক্স দেবে আর তারা কি শিক্ষা-চিকিৎসার নাগাল পাবে না? এক পরিসংখ্যান বলছে ৮০’র দশকে ঢাবিতে ৪৮ ভাগ ছেলেমেয়ে পড়তে আসত নিুবিত্ত ঘর থেকে। আর এখন মাত্র ১০ ভাগ সে সুযোগ পায়। এর কারণ কি নিছকই দারিদ্র? নাকি অব্যাহতভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ? মুক্তিযুদ্ধ তাহলে হয়েছিল কেন? পাকিস্তান তো এরকম রাষ্ট্রই ছিল? আওয়ামী লীগ কি ভুলে গেছে ’৭০-এর নির্বাচনী ইশতেহার। যেখানে বলা হয়েছিল, “এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করিতে হইবে, যাহাতে আর্থিক বিবেচনা কাহারও উচ্চতর শিক্ষালাভের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করিতে না পারে।” মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা বা চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করে কোন গণতন্ত্রের বাণী আওড়াচ্ছে এরা? বাস্তবে বর্ধিত ফি’র মাধ্যমে বছরে আদায় হবে সম্ভাব্য ২০ লক্ষ টাকা। আর এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৩ বছরে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ২২০০ শিক্ষক, স্টাফ নিয়োগ করা হয়েছে। এজন্য জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ঘাটতি হয়েছে ৩৬ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা। এই ঘাটতি মেটানোর দায় কি তবে ছাত্রদের?

শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সর্ম্পকিত দৃষ্টিভঙ্গিই চক্রান্তের মূলে কাজ করছে
একচেটিয়া পুঁজির লালসা মেটাতে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের খাদ্য, পানীয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মত মৌলিক অধিকার বিপন্ন হচ্ছে। এখন যার টাকা নেই, মৌলিক অধিকার বলতে তার কিছু নেই। বাংলাদেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র সংখ্যায় বাড়লেও গরীব মানুষের শিক্ষা চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে। উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ইউজিসি উচ্চশিক্ষার যে কৌশলপত্র (২০০৬-২৬) প্রণয়ন করেছে তার মূল কথা হল: সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দ দিন দিন কমিয়ে আনবে। এর ফলে যে বাজেট ঘাটতি হবে তা পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে – ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, আবাসন ও ডাইনিং চার্জ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা ভাড়া দেয়া, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া দেয়া ইত্যাদি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ের ফি বৃদ্ধি, নাইটকোর্স চালু কৌশলপত্র বাস্তবায়নেরই পদক্ষেপ। ইতোপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তা এই সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধেই।

ভবিষৎ বা ভরসা কোথায় তাহলে?
শতসহস্র ছাত্রসমাজের জেগে ওঠার মধ্যেই ভরসা। কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের বুকের বেদনাকে ধারণ করে লাঠি-গুলি-টিয়ারশেল উপেক্ষা করে যে সংগঠন বা ছাত্ররা রুখে দাঁড়াতে চেয়েছে বাণিজ্যিক অপতৎপরতা, মুষ্ঠিমেয় হলেও যে ৬ জন শিক্ষক স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইন্ধনদাতা হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে ছাত্রদের কাতারে শামিল হয়েছেন Ñ সংগ্রামের এ ধারাতেই তো ভবিষৎ। একদিন ৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহা বুক আগলে দাঁড়িয়েছিলেন, ‘আমাকে মাড়িয়েই তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে হবে।’ আসুন, মানুষের প্রতি ভালবাসা, দেশের প্রতি দায়বোধ নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে বলি, আমাদের মাড়িয়েই তবে বিশ্ববিদ্যালয়কে লাভের আখড়া বানাতে হবে, তার আগে নয়।

 অনুশীলন : সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments