[গত ১১ থেকে ১৪ মার্চ ভারতের সংগ্রামী কৃষক সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া কিষাণ ও ক্ষেতমজুর সংগঠন’ এর কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘বাংলাদেশের ক্ষেতমজুর ও কৃষক সংগঠন’ এর পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় আহবায়ক আলমগীর হোসেন দুলাল ‘বাংলাদেশের কৃষির উপর বহুজাতিক পুঁজির আক্রমণ ও কৃষক আন্দোলন’ নিয়ে একটি বিশদ আলোচনা করেন। এই আলোচনার প্রথম অংশ কিছুটা সম্পাদনা করে আমরা ‘সাম্যবাদ’-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম।]
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও শাসনব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিগোষ্ঠির বদলে বাঙালি উঠতি পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষাকারী দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিকভাবে কৃষি সংক্রান্ত নীতি প্রায় একই থাকে। স্বাধীনতার পর ‘সবুজ বিপ্লব’ ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রথমদিকে সার, বীজ, সেচ ব্যবস্থাপনার একক নিয়ন্ত্রণ ছিল ‘বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (BADC)’ এর হাতে। কিন্তু এরপর দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের স্বার্থে আশির দশকে ‘বিশ্বব্যাংক’, ‘আইএমএফ’ এর পরামর্শে আর্থিক খাত সংস্কার (Structural adjustment program) কর্মসূচী গৃহিত হয়। যার মূল কথা ছিল বাজার উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ, ভর্তুকি প্রত্যাহার, সরাসরি বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ ইত্যাদি। এর ফলে ধাপে ধাপে কৃষি উপকরণ ও ফসলের বাজারে রাষ্ট্রের ভুমিকা কমতে থাকে আর বাড়তে থাকে বিভিন্ন কোম্পানির বিনিয়োগ। যেমন, ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সার আমদানি ও সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল বিএডিসির হাতে। এরপর ১৯৮৪ সালে নিয়ন্ত্রণমলূক দামের ব্যবস্থা প্রত্যাহার, ১৯৮৯ সালে কারখানা ও বন্দর থেকে ব্যবসায়ীদের সার কেনার অনুমতি, ১৯৯২ সালে ব্যবসায়ীদের সরাসরি বিদেশ থেকে সার আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। একইভাবে ১৯৮৮-৮৯ সালে সেচ যন্ত্রপাতি ও পাওয়ারটিলার আমদানির ক্ষেত্রে সকল বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে ব্যবসায়ীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বীজ, কীটনাশকের ক্ষেত্রেও একইভাবে বাজার উন্মুক্ত করা হয়। একইসময়ে সরকারি ভর্তুকি কমতে থাকে। ১৯৭৯-৮০ সালে সারে ভর্তুকি ছিল ১২৮ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা, ১৯৯২-৯৩ সালে এসে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র আড়াই কোটি টাকায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রায় সকল ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৯০ সালের পর বিশেষতঃ গ্যাট চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর কৃষি উপকরণের বাজার প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিভিন্ন কোম্পানিনির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় বহুগুণ। কৃষকরা বাড়তি উৎপাদনখরচ জোগাড় করতে এনজিও ও মহাজনের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
উৎপাদিত ফসলের বাজারে প্রথমদিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকায় কৃষকরা কিছুটা লাভবান হচ্ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও ক্রমশ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকে। যেমন, ১৯৯৯-২০০০ সালে সরকারিভাবে মোটা ধান-চাল সংগ্রহে ধানের পরিমাণ ছিল ৮.৯২%। ২০১০-১১ সালে সেখান থেকে নেমে ০.৯৯% হয়েছে। সরকার ধান অপেক্ষা থেকে চাল অধিক সংগ্রহ করে। ফলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান না কিনে মিল মালিক ও বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে চাল ক্রয় করে। এভাবে প্রধান ফসল ধান থেকে শুরু করে সমস্ত ফসলের বাজার অল্প কিছু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসকল ব্যবসায়ীরাই মূলত ফসল ও খাদ্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বরাবরই বঞ্চিত হচ্ছে।
কৃষি উপকরণ ও ফসলের বাজার অল্প কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় কৃষক উপকরণ ক্রয়ে এবং ফসল বিক্রয়ে প্রতি নিয়ত ঠকছে। কৃষকরা এ প্রক্রিয়ায় ঋণগ্রস্ত হয়ে জমি-জমা বিক্রি করে ভুমিহীন কৃষক বা শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। অপরদিকে কৃষির সাথে সম্পর্কহীন এক শ্রেণির হাতে চলে যাচ্ছে ভূমির মালিকানা। জমি ভাড়া দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে ব্যাপক হারে। গত চার দশকে বর্গা, লিজ, ভাড়া দেয়ার পরিমাণ ২০ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশি-বিদেশি কর্পোরেট কোম্পানিগুলো কৃষি পণ্য উৎপাদনে সরাসরি এবং চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করছে। শুধুমাত্র প্রাণ-আরএফএল গ্রুপেরই ১ লক্ষ চুক্তিভিত্তিক কৃষক রয়েছে। এরকম বিভিন্ন কোম্পানি এবং ব্যক্তি পুঁজির মালিকরা ফল, সবজি, চা, মাছ চাষ, পশুপালনের জন্য জমি ক্রয় বা ভাড়া নিচ্ছে। পারিবারিক কৃষি খামারগুলো যদিও ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ছে বিপরীতে পুঁজিপতিদের একটি অংশ কৃষিতে বিনিয়োগের ফলে বড় খামারের সংখ্যাও বাড়ছে।
কৃষিতে কর্পোরেট প্রভাবের সবচেয়ে বড় প্রমাণ বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিক্রি ব্যবস্থার পরিবর্তন। ঐতিহাসিকভাবে এখানে কৃষকরাই বীজ সংরক্ষণ ও বিক্রি করত। কিন্তু গত কয়েক দশকে এক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হয়েছে। প্রধান ফসল ধান এখন উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাত নির্ভর। এ জাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কৃষক সরাসরি বীজ উৎপাদন করতে পারে না। ফলে ধান বীজের জন্য পুরোপুরি বিভিন্ন কোম্পানির উপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমানে ১০০০ কোটি টাকার ধান বীজ বাজারের ১৮% নিয়ন্ত্রণ করে ‘সুপ্রিম সিড’, বাকিটা ‘বায়ার ক্রপ’, ‘এসিআই’, ‘ব্র্যাক’, ‘ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার’ ইত্যাদি গ্রুপ। যেখানে বিএডিসি নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৬%। একইভাবে শাকসবজি বীজের ৩২% ‘লাল তীর’, ১৩% ‘মেটাল’, ১২% ‘জামালপুর সিড’ বাকিটা ‘মল্লিকা সিড’, ‘এসিআই’ সহ আরও অনেক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে।
সেচ, চাষ, মাড়াই এবং অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতির বাজারও একইভাবে কয়েকটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। কৃষি যন্ত্রপাতির বাজারের ৬৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, বাকি ৩৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। আমদানির প্রধান নিয়ন্ত্রক এসিআই, আলীম ইন্ডাস্ট্রিসহ অল্প কিছু গ্রুপ।
আধুনিক কৃষির অন্যতম বৈশিষ্ট্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নির্ভরতা। সার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, তাইবা সাইফুল্লাহ জি এল, টোটাল শিপিং এজেন্সি এবং পোটন ট্রেডার্সসহ আরও কিছু কোম্পানির সিন্ডিকেট। সারে ভর্তুকির বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাৎ করে এসকল কোম্পানি ।
দেশে বর্তমানে কীটনাশক বাজারের ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। বাংলাদেশে বালাইনাশক ব্যবসায় বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে সিনজেন্টা বাংলাদেশ লিমিটেড, বায়ার ক্রপ সাইন্স সরাসরি বাজারজাত করে।
উপরোক্ত তথ্য ও বিশ্লেষণ আলোকে বলা যায় বাংলাদেশের কৃষি খাত অল্প কিছু দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দখলে। এসকল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত তাদের মনুাফার স্বার্থে কৃষকদের শোষণ নিপীড়ণ করছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের লক্ষ্য হবে কৃষিক্ষেত্রে মুনাফালোভী পুঁজিপতিগোষ্ঠী ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ। কৃষি উপকরণ ও উৎপাদিত ফসলের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্যেই আছে যুগান্তর ধরে শোষিত কৃষক সমাজের মুক্তির পথ।