Thursday, March 28, 2024
Homeঅনুশীলনউচ্চশিক্ষা কমিশন : বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন হরণের নয়া কৌশল

উচ্চশিক্ষা কমিশন : বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন হরণের নয়া কৌশল

Einstein on academic freedom[dropcap]চি[/dropcap]ন্তার আপেক্ষিক স্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে চিন্তার বিকাশ ঘটে না। উন্নত চিন্তা মানুষের মধ্যে দায়বদ্ধতা তৈরি করে। একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে চিন্তা কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তির স্বার্থ বিবেচনায় কাজ করে না। বরং কখনও তা বিদ্যমান ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তাই যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে অনেক সময় তাকে বা তাদেরকে সমাজপতির রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হতে হয়। চিন্তার স্বাধীনতা ততটুকুই কার্যকর থাকে যতটুকু সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তা অনুশীলনের পরিবেশ পান বা পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট হন। কোন একটি উৎপীড়নমূলক সমাজে সমাজ ব্যবস্থাপকরা সবসময় নতুন ধ্যান-ধারণা কিংবা মুক্তচিন্তা দমন করতে চায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে এটা যেন আলো আর অন্ধকারের মধ্যে লড়াই।

জ্ঞানের বিকাশ ও চিন্তার ভুলভ্রান্তি নিরসনের জন্য চাই আলোচনার অবাধ স্বাধীনতা। আধুনিক কালের শুরু যদি রেনেসাঁকে ধরি সে সময়েও অনুসন্ধানের পথ যতটুকু অবারিত ছিল ততটুকুই তার অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একথাটিও প্রচলিত ছিল- ‘সবচেয়ে অজনপ্রিয় এমন মতামত প্রকাশ করার অনিঃশেষ স্বাধীনতা থাকতে হবে তা বিদ্যমান আবেগ-অনুভূতির নিকট যতই অপরাধমূলক বিবেচিত হোক না কেন’। এই স্বাধীনতা আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন এবং সমাজ প্রগতির অগ্রগতির শর্ত হিসেবে এটিকে অপরিহার্য বলে গণ্য করা উচিত। (চিন্তার স্বাধীনতার ইতিহাস – জে.বি. বিউরি)

সমাজ বিকাশের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটিও উন্নত হয়েছে
এই জ্ঞান বা মুক্ত চিন্তার অনুশীলন সবচেয়ে বেশি হতে পারে একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যাকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বলি। অষ্টাদশ শতাব্দীর রেনেসাঁ, সংস্কার আন্দোলন ও শিল্প বিপ্লবের যুগে ইউরোপ জুড়ে বিশেষত ইংল্যান্ডের সমাজের যে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছিল, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদালয়গুলো রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এর আগে পর্যন্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন ক্যাথলিক চার্চের মাধ্যমে সমাজ এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিচালিত হয়েছে। ধর্মীয় অন্ধত্ব ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান তথা সমাজজীবনকে প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে নতুন আলোর দিশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল রেনেসাঁর আন্দোলন। সামন্ত প্রভুদের একাধিপত্য আর খ্রিস্টধর্মের পুরোহিততন্ত্রের প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ করে ইউরোপে বৈজ্ঞানিক চিন্তার উদ্ভব হলো। ফ্রান্সিস বেকন, গ্যালিলেও, ব্রুনো, টরিসেলি প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ দেখালেন এ যাবৎকালের প্রচলিত বহু চিন্তাই ভ্রান্ত। দেখালেন, বিশ্বাসের উপর ভর করে নয়, সমস্ত কিছুই গ্রহণীয় হতে হবে যুক্তির কষ্ঠি পাথরে। তৎকালীন সমাজের জন্য প্রচণ্ড আঘাত হিসেবে আসা এই চিন্তাগুলোকে নানাভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়, তাঁদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু সত্যের মধ্যে যে অমোঘ শক্তি থাকে তাকে কোনো দমন-পীড়ন চালিয়েও চিরতরে নিঃশেষ করা যায় না। বিশেষত স্থল ও জলপথে দূর দূরান্তে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার, নতুন নতুন ভূ-খ- আবিষ্কার, মুদ্রণযন্ত্র, লেন্স, ঘড়ি প্রভৃতির আবিষ্কার বহু নতুন তথ্য ও পর্যবেক্ষণ জনসম্মুখে নিয়ে আসে। এতে করে যারা এতদিন চোখ বন্ধ করে ছিল তাদেরও অন্ধবিশ্বাস ভাঙ্গতে শুরু করে। সেদিন সামাজিক প্রয়োজন থেকেই এই চিন্তাগুলো এসেছিল। কেননা ধর্মীয় অন্ধতা ও কুসংস্কারের বিষময় প্রভাব কাটিয়ে জনগণের মধ্যে যুক্তিশীল মানসিকতা গড়ে না তুললে তারা সামন্ততান্ত্রিক বাঁধন কেটে বেরুতে পারবে না, শিল্পে শ্রমিক পাওয়া যাবে না। তাই শিল্প বিপ্লবের নেতারাই সেদিন বিজ্ঞান চিন্তা, যুক্তিবাদী মনন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা নিয়েছিলেন। চিন্তাজগতের এই পরিবর্তনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রও পাল্টে দিল। উল্টোদিক থেকে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত নতুন এবং উন্নত চিন্তা সমাজ মননে গভীর ছাপ ফেলল। সুতরাং চৌদ্দ ও পনের শতকের রেনেসাঁ আন্দোলন, ১৬ শতকের রিফর্মেশন, ১৭ শতকের গৃহযুদ্ধ ও বিপ্লব এবং ১৯ শতকের শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমাজে যে মৌল পরিবর্তন সূচিত হলো তার সাথে সম্পর্কিত করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র, উচ্চতর জ্ঞানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি জড়িয়ে রইল।

teach-the-controversyবিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি এসেছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। শিল্প বিপ্লবের পর তা আরও সুনির্দিষ্টতা পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করবে, কোন কিছু এমনকি আর্থিক প্রয়োজনের জন্যেও তাকে অধীনস্থ করে রাখা যাবে না। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে দায়বদ্ধতা পালন করবে। এ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা মেলে ১৯৬৫ সালে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক এসোসিয়েশনের (ওঅট) একটি সম্মেলনের গৃহীত বক্তব্যে – Whatever the formalities of appointment may be, the university should have the right to select its own staff. Universities should be responsible for the formation of curricula for each degree and for the setting of academic standards. In those countries, where degrees or the license to practice a profession are regulated by law, universities should participate effectively in the formation of curricula and the setting of academic standards. Each university should have the final decisions as to the research programme carried on within its wall. The university should be responsible, within wide limits, for the allocation among its various activities of the financial resources available i.e space and equipment; capital funds; recurrent operating revenue. অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে ছাত্র ভর্তি, কোর্স কারিকুলাম নির্ধারণ, গবেষণা পরিচালনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার থাকবে। এভাবেই সেদিন স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা ও তার প্রয়োগের সীমা নির্ধারিত হয়েছিল।

সময়ের প্রেক্ষিতে এই চিন্তা আরও বিকশিত হবারই কথা ছিল। কেননা জ্ঞান বিকশিত করার অন্যতম শর্ত তার পরিপূরক অবাধ পরিবেশ। কিন্তু বিশ্বজুড়ে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ধারণা ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়েছে। দেশে দেশে শাসকরা আর চায় না মুক্তিবুদ্ধি চর্চার অবাধ পরিবেশ থাকুক। সামন্তযুগে যেভাবে যাজকরা যুক্তিবাদী, সৃজনশীল, উন্নত চিন্তাকে ভয় পেয়েছিল আজ সেই জুজু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বুর্জোয়া শাসকদের। কেননা একটা নিপীড়নমূলক সমাজের জন্য অনুসন্ধিৎসা, যুক্তিবাদিতা, প্রগতিশীলতা খুব আতঙ্কের। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু উন্নত চিন্তার জন্ম হয় তাই তার স্বায়ত্তশাসন শাসকদের কাছে খুব দুঃশ্চিন্তার বিষয়।

আমাদের দেশেও সংগ্রামের পথ বেয়ে স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটি মূর্ত হয়েছে
আমাদের দেশেও স্বাধীনতার লড়াইয়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল। বৃটিশদের উপনিবেশিক শাসনকাল কিংবা পাকিস্তানিদের প্রায় উপনিবেশিক শাসনকালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকুও প্রদান করা হয়নি। আইন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিধান করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ১৯৬১’; ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট ১৯৫৩’; ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬১’ এরকমই কয়েকটি কালাকানুন। শাসকরা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি পদানত রাখতে। কিন্তু দেশের স্বাধীকারের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শাসকদের সেই আকাক্সক্ষা সফল হয়নি। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে দেশের মানুষকে পাকিস্তান সরকারের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সচেতন করা, ’৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কুখ্যাত কালাকানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ এর ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ এর নির্বাচন এবং সর্বোপরি ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ- এই প্রত্যেকটি লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালন করেছে। এভাবে রাজনৈতিক-সামাজিক লড়াই আর অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেই সেদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায় করতে পেরেছিল। তাই বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কোনোভাবেই একটি দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাইরে অবস্থান করতে পারে না। গীর্জা ইতিহাসের প্রখ্যাত পণ্ডিত ভিভিয়ান গ্রীন যেমন ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনীতি’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন “Throughout history the universities have been more or less connected with politics.” আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আলোচনা করতে হলে এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনতে হবে। (বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্তশাসন – শহীদুল ইসলাম)

প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষা কমিশন : বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কফিনে শেষ পেরেক মারার আয়োজন
Freedomস্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩’ এর মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়। এই অধ্যাদেশে অনেক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর এটিই ছিল তুলনামুলক অর্থে প্রগতিশীল। কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং পরবর্তীতে যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার কোনটিকেই এর আওতায় আনা হয়নি। বর্তমান সময়ে এই স্বায়ত্তশাসনের ধারণাকে আরও বেশি সঙ্কুচিত করা হয়েছে। বস্তুত শাসকরা এখন তাদের নিজেদের পরিকল্পনাকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করছে। সরকারের এই পরিকল্পনার সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে উচ্চশিক্ষা কমিশন (Higher
Education Commission)।

শিক্ষানীতি ২০১০ এ একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ ছিল। আমরা পূর্বের বেশ কিছু আলোচনায় দেখিয়েছিলাম, কিভাবে শিক্ষানীতি ২০১০ শিক্ষার বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করছে এবং শিক্ষার মননশীলতাকে ধ্বংস করে ধর্মীয় কূপমূণ্ডক চিন্তার সাথে বিজ্ঞানের কারিগরি দিককে মিলিয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদী মনন কাঠামো তৈরি করছে। বাস্তবে শিক্ষা সম্পর্কিত শাসকদের এই মনোভাবকে আরও বেশি পাকাপোক্ত করতে সরকার স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। এই চিন্তাকে বাস্তবে রূপদান করতে সরকার উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের খসড়া প্রস্তাব হাজির করেছে। এ সম্পর্কিত ধারণাগুলো এখনও পরিপূর্ণ রূপে প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত না হলেও অতীতের অভিজ্ঞতায় এবং যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে এটা পরিস্কারভাবেই বোঝা যায় এই কমিশন উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে ভয়ংকর বিপদ ঢেকে আনবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের।
দেশের ৩৪টি পাবলিক ও ৭৮টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকর্তারূপে উচ্চশিক্ষা কমিশনকে প্রতিষ্ঠা ছাড়াও দেশে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রকও করার প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ‘ক্রসবর্ডার হায়ার এডুকেশন (সিবিএইচই)’ এবং ‘ট্রান্সন্যাশনাল এডুকেশন (টিএনই)’ নিয়ে এখানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ১ জন চেয়ারম্যান আর ৫ জন পূর্ণকালীন সদস্য নিয়ে কমিশন গঠিত হবে। এর বাইরে আরও ১২ জন খণ্ডকালীন সদস্য থাকবে। এই ১২ জন খণ্ডকালীন সদস্যের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ৩ জন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ৩ জন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডিন ক্যাটাগরি থেকে ৩ জন এবং পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের ৩ জন সদস্য থাকবেন। এদের মেয়াদ হবে ২ বছর। তবে স্থায়ী সদস্য ও চেয়ারম্যানের মেয়াদ হবে ৪ বছর।

কি আছে প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষা কমিশনে?
দৈনিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা কমিশন সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে –
# দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ‘ইউজিসি’কে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে এই কমিশনকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
# যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর যেকোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কমিশন নিতে পারবে।
# সবগুলো পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এটি হবে একটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর নজরদারি চালানো হবে।
# বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে এই কমিশনের মাধ্যমে
# প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং পেশাগত জবাবদিহিতা বজায় রাখবেন।
# সরকারি-বেসরকারি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হবে এবং উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে কাজে লাগানো হবে।
# শিক্ষার চাহিদা নিরূপণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতি-নির্ধারণের ক্ষমতা থাকবে।
# বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্য-ব্যর্থতা নিরূপণের জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ড নির্ধারণ করবে এবং ওই মানদণ্ডের ভিত্তিতে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পারস্পরিক অবস্থান বা মানক্রম নির্ধারণ করবে।
# উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ব্যক্তি বা সরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণ/ নিরূপণ সংস্থা বা অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও পরামর্শ প্রদান করবে।
# পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হবে কমিশনকে।
# কমিশনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নীতিমালা, বিধি, প্রবিধি ও স্ট্যাটিউটস প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা দেয়া হবে।

প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষা কমিশন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত তেমন কিছু জানা না গেলেও যতটুকু বক্তব্য পাওয়া গেছে, তাতেই পিলে চমকে যাবার যোগাড় ! অনেক ভালো কথার আড়ালে বাস্তবে উচ্চশিক্ষা কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্ণরূপে স্বায়ত্তশাসনহীন, পরাধীন, পরিপূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। এর মাধ্যমে সরকার শিক্ষা বাণিজ্য এবং শিক্ষা সংকোচনের নীতিকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে চায়। কোর্স-কারিকুলাম প্রণয়নেও বর্তমান বাজারের পরিপূরক নীতি কার্যকর করবে। এবং যতই দমনপীড়ন চালানো হোক না কেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের রাস্তাও বন্ধ করে দিতে চায়। বাস্তবে ‘শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরের বিশ্বব্যাপী চলমান নীতি’কেই এই কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যকর করা হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার মূল মর্মবস্তুই ধ্বংস হয়ে যাবে। উচ্চশিক্ষা কমিশন নিয়ে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘সরকারি বরাদ্দের উপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার খর্ব হচ্ছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে সরকারের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা কমাতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এজন্য নিজেদেরই উদ্যোগী হতে হবে।’ তখন এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না, উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণের নীতিকে সরকার এই কমিশনের মাধ্যমে আরও জোড়ালোভাবে  বাস্তবায়ন করবে।

শিক্ষাব্যবসা নিয়ে শাসকশ্রেণীর পরিকল্পনা বিশ্ব ব্যবস্থার সাথেই যুক্ত
শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অবস্থা কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিশ্বব্যাপী বড় বড় পুঁজিবাদী দেশগুলোর বাজার সংকটের কারণে পুঁজি বিনিয়োগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষাকে তারা বেছে নিয়েছে। এখান থেকে তারা মুনাফাও করছে প্রচুর। সম্প্রতি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ ৩০টি পুঁজিবাদী দেশকে নিয়ে Organisation for Economic Co-operation and Development (OECD) নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। এর ঘোষিত উদ্দেশ্য বিশ্বায়নের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক-সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলি সমাধান করা। ২০০৯ সালে এই সংগঠন ‘অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা নীতি : দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক উন্নতির নয়া পদ্ধতির অনুসন্ধান’ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এখানে সদস্য দেশগুলিকে এই সংকটকাল পরিত্রাণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে, এই অসুস্থ অর্থনীতিকে একমাত্র চাঙ্গা করে তুলতে সক্ষম ‘শিক্ষায় বিনোয়োগ’। কারণ প্রথমত, যে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র না পেয়ে অলস ও স্থিতিশীল হয়ে আছে তার নিশ্চিত মুনাফার জন্য শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা যায়। দ্বিতীয়ত, অথনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান সংকট জর্জরিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমনির্ভর শিল্পোদ্যোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে শিল্পপতিরা পুঁজি নির্ভর শিল্পোদ্যোগের দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ ব্যাপকভাবে কমলেও এই শিল্পগুলিতে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ কিছু শ্রমিকের প্রয়োজন এখনও আছে। তাই কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ এখনও লাভজনক। পুঁজিকে এভাবে কাজে লাগাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

উচ্চশিক্ষা কমিশন কোন্ শিক্ষামান নিশ্চিত করতে চায়?
প্রশ্ন আসে, শিক্ষার কোন মান কিংবা কি চাহিদা উচ্চশিক্ষা কমিশন পূরণ করতে চায় এবং এ জন্য কি ধরনের পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করতে চায়? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের খেয়াল করতে হবে উচ্চশিক্ষাকে নিয়ে সরকারের নীতিগত দিকটিকে। স্বাধীনতার পর বিশেষত ১৯৯০ সাল পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। শিক্ষার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিশ্বব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে বাণিজ্যিকীকরণের নীতিকে কার্যকর করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়ী, এনজিও, সরকার দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের হাতে ছেড়ে দেয় এবং ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৭৮টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দান করে। গত ২০১২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুনাফা করেছে ১ হাজার ৮৫০ কোটি ৪২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। একই বছরে গবেষণার পেছনে তারা ব্যয় করেছে মাত্র ৪১ কোটি ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা, যা সামগ্রিক আয়ের মাত্র ২.৩% আর সামগ্রিক ব্যয়ের ২.৪১%। ২০১২ সালে ৬০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫টি গবেষণার পেছনে এক পয়সাও ব্যয় করেনি। (সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে সংগৃহীত) সরকারের লক্ষ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা এবং পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের অবাধ মুনাফার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। পুঁজি সর্বোচ্চকরণ কিংবা মুনাফা আদায়ের জন্য যখন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় তখন তাকে সেভাবেই সাজিয়ে নিতে হয়। শিক্ষার সামাজিক চরিত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট রাখার প্রয়োজন থাকে না।

২০১০ সালের ইউজিসির রিপোর্ট বলছে, গত দশ বছরে বাজারমুখী বিষয়গুলোতে (ব্যবসা-বাণিজ্য, ফলিত বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ) স্নাতক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তাই পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই বিষয়সমূহ সংযোজন এবং সিট সংখ্যা বাড়িয়েছে।

একইভাবে প্রত্যেকটি পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রত্যেক বিভাগে সেমিস্টার, গ্রেডেশন, কোর্স ক্রেডিট এ সমস্ত পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করেছে। পঠিত বিষয়বস্তু এবং তার মূল্যায়ন পদ্ধতি যদি আমরা খেয়াল করি তবে দেখব শিক্ষা বাজারের ক্রেতা হিসেবে বিবেচিত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবাধ চলাচল এবং বিনিয়োগকারীদের সুবিধা মতো পাঠক্রম পরিবর্তন করার স্বাধীনতা দানের জন্যই এগুলো করা হয়েছে। বাস্তবে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা One Window Education System গড়ে তুলতে চায়। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে কোর্স কারিকুলামের সাথে সাথে মূল্যায়ন পদ্ধতিরও একটা মিল থাকবে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এক সেমিস্টারের পরীক্ষার পর পূর্ববর্তী পাঠ্যসূচি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। একেকটা বিষয়ের উপর খুব সামান্যই সেখানে পড়ানো হয়। ৪ মাস কিংবা ৬ মাসে কত বেশিই বা পড়ানো সম্ভব? অল্প বিষয়ের উপর পড়াশুনা হবার কারণে এই পদ্ধতিতে উঁচু গ্রেড ও অনেক নম্বর পাওয়ার রাস্তা সহজ হয়েছে সত্যি কিন্তু শিক্ষার্থীরা এ কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নতুন বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে কিংবা বিস্তৃত অধ্যয়ন করতে সময়ই পায় না। সর্বদাই পরীক্ষার ব্যস্ততায় তাড়িত হয়। এর সাথে আছে যত বেশি পরীক্ষা তত বেশি পরীক্ষা ফি, ভর্তি ফি। ফলে শিক্ষা ব্যবসাও তাতে ত্বরান্বিত হয়। এছাড়া প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট ইত্যাদি আয়োজন একটি বিষয়কে গভীর উপলব্ধির সহায়ক না হয়ে শিক্ষার্থীর উপর বোঝাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পদ্ধতি বর্তমানের ঔড়ন ড়ৎরবহঃবফ  পাঠক্রমের জন্য উপযোগী কিন্তু বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, মেডিকেল ও অন্যান্য ফলিত বিজ্ঞানের সুসংহত ও সর্বব্যাপক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তা চূড়ান্ত ক্ষতিকারক। সারাদিন পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ততার কারণে রাজনীতি, সমাজ দর্শন নিয়ে চিন্তা করার সময়টুকু পর্যন্ত তারা পায় না।

প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষা কমিশনে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে আমাদের দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা চালু করা হবে। একইসাথে কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের একটি মান নির্ধারণ করা হবে যার মাধ্যমে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের  র্যর্কিং নির্ধারিত হবে। এটি সরকারের শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ তীব্রতর করার আরেকটি অপকৌশল। বাস্তবে কমিশনের মাধ্যমে সরকার দেশি বা বিদেশি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিং ভ্যালু তৈরি করবে। অর্থাৎ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি পাবে কিন্তু তার জন্য বিপুল হারে টিউশন ফি’সহ অন্যান্য ফি দিতে হবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা তাদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বাধ্য হবে। উচ্চশিক্ষা নয়, প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ভ্যালুই এখানে মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হবে। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের উদ্দেশ্যও হবে তাই। পরবর্তীতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই পরিকল্পনার অনুগামী হবে। শিক্ষার মানদণ্ডের নিরিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং নির্ধারণের যে কথা বলা হয়েছে তার মধ্যেও সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে। র‌্যাংকিং-এর অজুহাত তুলে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দের বিষয়ে পার্থক্য তৈরি করবে।

বাজার ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করার এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রের (২০০৬-২০২৬) মাধ্যমে। এই কৌশলপত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমকে এমনভাবে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা আছে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্রতা-নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না এবং সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত হয় বর্তমান দেশীয়-আন্তর্জাতিক বাজারের অনুকূলে ও সরকারের নিয়ন্ত্রণে। রয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের সুপারিশ যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা নির্মাণ, শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটানো, উৎকর্ষতা আদায়সহ বহু বিষয়ের গালভরা আশ্বাস। বাস্তবে এর মাধ্যমে সরকার শিক্ষা নয়, শিক্ষা বাজারের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে; শিক্ষার বাজারে ধনী ক্রেতাদের প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছে। সেই সময়েই অর্থাৎ ২০০৬ সালে সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরিপূরক ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ নিজেদের ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ এ রূপান্তরের সুপারিশ করেছিল। (The UGC might be renamed ‘Higher Education Commission’ (HEC), with an appropriate set of terms of reference. This will give the commission a better image and help to signal the strengthening of its authority and roles (University Grant Commission, 2006, pp. 22, 23) এভাবে সরকারের ইচ্ছায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আলোকে উচ্চশিক্ষা কমিশনের যাত্রা শুরু হয়।

স্বায়ত্তশাসন ধ্বংসের চক্রান্ত নতুন নয়
উচ্চশিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে সারাদেশের ১১২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। কেননা উচ্চশিক্ষা কমিশনে যারা থাকবে তাদের নিয়োগ করা হবে সরকারের মাধ্যমে। যেকোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা উচ্চশিক্ষা কমিশনকে দেয়া হবে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ধারণার পরিপন্থী। সরকার ভালোমতই জানে, যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়, তবে সমাজে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা একটা বড় শক্তিকেই দমন করা যাবে। যেকোন নির্যাতনমূলক সমাজব্যবস্থায় এই প্রক্রিয়াতেই নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল তখনও স্বায়ত্তশাসনেরর কথা বলা হয়নি। এ সময় নাথান রিপোর্ট বের হয়। যার প্রধান কথা ছিল – It’s the head of the institution will be a Government Institution, it will be ruled by the Government and the head of the institution will be the Director of the Public Institution. পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেই সময়ই শাসকদের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ব্যাপক ছাত্র গণআন্দোলন গড়ে উঠে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) কে কিছুটা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়। যদিও ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশেও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা শাসকরা জিইয়ে রেখেছিল। যেমন এই অধ্যাদেশে উপাচার্য নির্বাচনের বিষয়ে বিশেষ পরিস্থিতি দেখিয়ে সিনেটের নির্বাচন ব্যতিরেকেই সরাসরি আচার্য (দেশের প্রেসিডেন্ট) উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারেন। এরকম বিধান থাকার ফলে দীর্ঘদিন যাবৎ সিনেটকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। সরাসরি আচার্য উপাচার্য নিয়োগ দিচ্ছেন সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায়। ফলে ’৭৩ এর অধ্যাদেশেও স্বায়ত্তশাসন খর্ব হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারপরও যতটুকু স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আছে বর্তমানে তাকেও কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত চলছে। ২০০৬ সালের প্রণীত কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ‘সিনেট ও সিন্ডিকেটে অংশগ্রহণ এবং উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা-মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তার ভূমিকা রাখতে পারে।’ ২০০৭ সালের জুলাই মাসে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার চালু করেছে আমব্রেলা এ্যাক্ট। এখানে ভিসিকে দেয়া হয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং সার্চ কমিটির মাধ্যমে ভিসি নিয়োগের সর্বময় ক্ষমতা এসেছে সরকারের হাতে। আর বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তারা মূলত সরকারদলীয় ব্যক্তি।

এর সাথে উচ্চশিক্ষা কমিশনে গৃহীত প্রস্তাবনা দেখলে বোঝা যাবে সরকার এখন আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাশা করে। চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য পূর্ণকালীন সদস্যদের নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট। জবাবদিহিতা থাকবে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে। অস্থায়ী সদস্য হিসেবে থাকবেন পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন ভিসি। আগেই বলা হয়েছে, ভিসি নিয়োগের অন্যতম যোগ্যতা কি। এছাড়াও থাকবেন সরকারের ৩টি মন্ত্রণালয়ের ৩ জন সচিব। তাই এর বাইরে ডিন কিংবা অধ্যাপক ক্যাটাগরির ৩ জন কোনো প্রশ্নে ভিন্নমত গ্রহণ করলেও উচ্চশিক্ষা কমিশন সমস্ত অর্থেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যখন যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সর্বময় অধিকার পেয়ে যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার ক্রীড়নকে পরিণত হতে আর কোনো বাধা থাকে কি?

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কেন প্রয়োজন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার অগ্রগতি, বিস্তৃতি, তাকে কার্যকররূপে প্রয়োগ, পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি করে। এই কাজ কখনও বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপে মুক্ত-স্বাধীনভাবে করা সম্ভব হয় না। প্রশাসনিক এবং একাডেমিক অনেক ধরণের কর্মকাণ্ড একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা করতে হয়। যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের যোগ্যতা নিরূপণ, শিক্ষক (ভিসিসহ)-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং ডিগ্রির মাপকাঠি নির্ধারণ, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ-গবেষণার মধ্যে সমন্বয় সাধন, গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধারণ, প্রকাশনা, মতামত প্রকাশ ও তার পরিপূরক কর্মকাণ্ডের অধিকার, সত্য প্রকাশের নিঃশঙ্ক পরিবেশ ইত্যাদি। কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সকল অধিকার একমাত্র স্বায়ত্তশাসন থাকলেই নিশ্চিত করা যায়। আর তা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় তার উপযুক্ত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কোন নিয়মে চলছে তা নিরূপণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি শোষকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, নির্ভয়ে সত্য বলার সাহস-যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তবেই তা প্রগতির আলোকবর্তিকা রূপে হাজির হয়। আর যখন প্রচলিত সমাজের নিয়মে চলে তখন স্বাধীনতা-স্বকীয়তা হারিয়ে শোষকের বাধ্যগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, শোষকের হাতকেই পাকাপোক্ত করে। ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি সমাজে উন্নত ব্যক্তিত্ব, সামাজিক চেতনা, মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রচলিত সমাজকাঠামোর জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দেয়। গণআকাক্সক্ষার পরিপূরক সামাজিক বিকাশের জন্য যেমন উন্নত চিন্তা প্রয়োজন তেমনি প্রচলিত সমাজকাঠামো ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন একে নিয়ন্ত্রণ করা। তাই বিশ্ববিদ্যালয় যতটুকু স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে তা অর্জিত হয় শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার লড়াইয়ের মাধ্যমে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে উচ্চশিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে সরকারের অপচেষ্টাকে আমাদের বুঝতে হবে।

জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন একসূত্রে গাঁথা
শিক্ষা যেহেতু সমাজ মননের চালিকাশক্তি তাই তাকে ঘিরে সমাজপতিরা সবসময়ই পরিকল্পনা করে। এর মাধ্যমেই সমাজের চাকা কোন পথে অগ্রসর হবে, তা নির্ধারিত হয়। আর চিন্তা-মননের সর্বোন্নত বিকাশ ঘটে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বহুদিন আগে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে বলেছিলেন “আলো জ্বেলে দে‘রে শুধু আলো জ্বেলে দে! গ্রামে গ্রামে লোকে অন্ধকারে কানা হয়ে গেল; একবার তাদের চোখ মেলে দেখবার উপায়টা করে দে বাবা! তখন আপনি দেখতে পাবে তারা কোনটা কালো, কোনটা ধলো।” শাসকরা এ সত্যকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। তাই প্রকৃত শিক্ষার আলোটুকু তারা জ্বালতে দেয় না। জনগণকে অজ্ঞানতা আর কূপমণ্ডূকতার জালে আবদ্ধ রাখতে চায়। তারপরেও যতটুকু শিক্ষার সুযোগ মেলে, শিক্ষিত এই মানুষগুলোও যেন শোষণের মূল সূত্রকে ধরতে না পারে সে জন্য কত আয়োজন। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, The end of all education, all training should be man making। তা বুঝতে পেরে যেন শাসকরা একদিকে ধর্মান্ধতা অন্যদিকে কারিগরি-প্রযুক্তির শিক্ষা দিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতা-যুক্তিবাদী মননকাঠামোকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে শোষণ-লুটপাট, অন্যায়-অনাচার সবই চলছে কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার দিকে আঙ্গুল তুলছে না কেউ। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এমন করে তাড়া করে ফিরছে যে যেভাবেই হোক অর্থ উপার্জন আর আকণ্ঠ ভোগের মধ্যে খুঁজে ফিরছে জীবনের উদ্দেশ্য। অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে গিয়ে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও উচ্চতর দায়বোধ-মানবিকতার লেশ মাত্র তাতে থাকছে না।

শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, জনগণের অন্যান্য অধিকারও এভাবে শোষকের যাঁতাকলে পিষ্ঠ। খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান সকল ক্ষেত্রেই সরকারের শোষণমূলক নীতির বাস্তবায়ন। তাই দেশজুড়ে একদিকে লক্ষ কোটি নিরন্ন-অসহায়-বুভুক্ষু মানুষের আর্তনাদ অন্যদিকে অল্পকিছু মানুষের আকাশচুম্বী বিত্ত-বৈভবের বিলাসিতা। এতবড় বৈষম্যের সমাজ কিন্তু তারপরও তা কিভাবে টিকে আছে? এখানেই প্রকৃত শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রশ্নটি যুক্ত। শাসকরা আমাদের সেই শিক্ষাই দিতে চায় যাতে করে এই অন্যায়-অত্যাচার দেখেও আমাদের মধ্যে আর্তনাদ-কষ্ট তৈরি না হয় কিংবা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-লড়াইয়ে উদ্যত না হই। আর এ কারণেই তারা শিক্ষার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর খড়গহস্ত হয়, স্বাধীনতাকে বার বার টুঁটি চেপে ধরে। তাই একথা বলা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের যে সঙ্গীণ অবস্থা তা এদেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের জীবনেরই প্রতিফলন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার লড়াইকে বেগবান করলে তা একদিকে শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মেহনতী মানুষের অধিকারকে যেমন মূর্ত করবে, তেমনি মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অংশ নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ও ফিরে পাবে তার স্বাধীনতা-স্বকীয়তা। এ যেন একটি অপরটির পরিপূরক।

 অনুশীলন : সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments